ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে দেশে ক্রমশ ইন্টারনেট সেবার প্রসার হচ্ছে। গ্রামগঞ্জে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সেবা চালু হয়েছে। তবে মানসম্মত ইন্টারনেট সেবা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ লক্ষ্য করা যায়। দেশে ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধি করতে ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর থ্রিজি সেবা চালু করা হলেও এখনও রাজধানীর বাইরে এ সেবা ঠিকমতো পাওয়া যায় না। সেখানে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দেশে ফোরজি সেবা চালু হল। ফোরজি সেবা বাংলাদেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা কতটুকু পূরণ করতে পারবে? সেটি হয়তো সময়ই বলে দেবে।
ফোরজি এলটিই কী?
ফোরজি হল ফোর্থ জেনারেশন বা চতুর্থ প্রজন্ম শব্দটির সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি ব্যবহৃত হয় চতুর্থ প্রজন্মের তারবিহীন টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তিকে বোঝাতে। এটি তৃতীয়প্রজন্মের (থ্রিজি) টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির উত্তরসূরি। ফোরজি প্রযুক্তি ল্যাপটপ, স্মার্টফোন বা অন্যান্য মোবাইল যন্ত্রে মোবাইল ব্রডব্যান্ড মোবাইল আল্ট্রা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে থাকে। ফোরজি নেটওয়ার্কে যেসব সুবিধা পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে সংশোধিত মোবাইল ওয়েব সেবা, আইপি টেলিফোনি, গেমিং সেবা, এইচডিটিভি, হাই-ডেফিনেশন মোবাইল টিভি, ভিডিও কনফারেন্স, ত্রিমাত্রিক টেলিভিশন এবং ক্লাউড কম্পিউটিং উল্লেখযোগ্য। আর এলটিই (LTE-Long Term Evolution) হল মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের ফোরজি বা চতুর্থ প্রজন্মের একটি প্রযুক্তি। ইংরেজি এলটিই দিয়ে হয়- লং টার্ম ইভালুয়েশন, এর পুরো নাম থ্রিজিপিপি লং টার্ম ইভ্যুলুশন (3GPP Long Term Evolution)।
বাংলাদেশে ফোরজি সেবার সীমাবদ্ধতা
বিপুলসংখ্যক সিম রিপ্লেসমেন্ট, উপযুক্ত হ্যান্ডসেটের অভাব, এখনই আইফোনে সুবিধা না পাওয়া, আন্তর্জাতিক গতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যতা, সেবার মান নিয়ে সংশয়সহ ফোরজি বাস্তবায়নে নানা সংকট তৈরি হয়েছে। এসব জটিলতার মধ্যেই ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ফোরজি সেবা চালু হয়েছে। ওইদিন ঢাকা ক্লাবে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মোবাইল অপারেটরদের কাছে আনুষ্ঠানিক ফোরজি লাইসেন্স হস্তান্তর করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
ফোরজির আলোকবর্তিকা ঘিরে অনেক স্বপ্নযাত্রা শুরু হলেও সেখানে অন্ধকার ঘিরে আছে। নানা সীমাবদ্ধতায় ঢেকে আছে গতির ইন্টারনেট। বিটিআরসির সর্বশেষ হিসাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট মোবাইল সিম ব্যবহারকারী ১৪ কোটি ৫১ লাখ ১৪ হাজার। এর মধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ৭ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার। প্রায় ১৫ কোটি সিম ব্যবহারকারী সবাই বায়োমেট্রিক সিম রেজিস্ট্রেশন করেছে। এখন কেউ ফোরজি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হলে তাকে অঅবার সিম রিপ্লেস করতে হবে। নতুন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য অপারেটররা প্রস্তুত আছেন। তবে সেটি কতদিনে বা কত বছরে সম্ভব হবে তার উত্তর কারও জানা নেই।
গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাইকেল ফোলিও বলছেন, আমরা বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন করার সময় যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা দিয়েই পরবর্তী ফোরজি সিম রিপ্লেসমেন্ট জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারব।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিম রিপ্লেসমেন্ট জটিলতা ছাড়াও আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ফোরজি হ্যান্ডসেটের অপ্রতুলতা। ফলে সিম আর হ্যান্ডসেট না থাকার কারণে কাক্সিক্ষত ফোরজি সেবা থেকে দূরে থাকতে হবে গ্রাহকদের। দেশে ১৫ লাখ আইফোন ব্যবহারকারী রয়েছেন। তাদের জন্যও দুঃসংবাদ রয়েছে। অ্যাপল কোম্পানির হ্যান্ডসেটগুলোতে বাংলাদেশের কান্ট্রি কোড ‘+৮৮০’ লক থাকায় আইফোন ব্যবহারকারীরাও বাংলাদেশে ফোরজি ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছেন না। যদিও বিটিআরসি বলছে, শিগগির এটা সমাধান করার জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
ফোরজি : বাংলাদেশ বনাম বহির্বিশ্ব
বর্তমান বিশ্বে ১৮০টি দেশে ফোরজি চালু আছে। তাতে গড় গতি ১৬.৬ এমবিপিএস। সবচেয়ে গতি বেশি আছে সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় যথাক্রমে ৪৬.৬৪ ও ৪৫.৮৫ এমবিপিএস। এ ছাড়া নরওয়ে হাঙ্গেরিতে ৪২ এমবিপিএস। তবে বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ে ইন্টারনেটের বর্তমান গতি সে তুলনায় খুবই কম। বিটিআরসির তথ্যমতে দেশে ইন্টারনেটের গড় গতি ২.১ এমবিপিএস বা তারও কম।
কোন অপারেটরের কত তরঙ্গ
মূলত তরঙ্গের মাধ্যমেই আমরা মোবাইল অপারেটরদের সেবা গ্রহণ করে থাকি। ১৩ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসির আয়োজনে দেশে ফোরজির নিলাম সম্পন্ন হয়। এই নিলামে অংশ নেয় গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক। নিলামে মোবাইল অপারেটর বাংলালিংক ২১০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে ৫ মেগাহার্জ তরঙ্গ কেনে। যার দর ২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলালিংক ১৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে ৫ মেগাহার্জ তরঙ্গ কেনে। এই তরঙ্গের মূল্য ২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে গ্রামীণফোন ১৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে ৫ মেগাহার্জ তরঙ্গ কেনে।
নিলামের পূর্বে গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটকের কাছে যথাক্রমে বিভিন্ন ব্র্যান্ডে মোট ৩২, ৩৬.৪, ২০ এবং ২৫.২ মেগাহার্জ তরঙ্গ ছিল। নিলামের পর গ্রামীণফোন ও বাংলালিংকের তরঙ্গ বেড়ে দাঁড়াল যথাক্রমে ৩৭ ও ৩০.৬ মেগাহার্জ। এয়ারটেলের সঙ্গে রবি একীভূত করায় অপারেটরটির তরঙ্গ সব অপারেটরের চেয়ে বেশি ৩৬.৪ মেগাহার্টজ থাকায় নিলামে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল। গ্রামীণফোন ১৮০০ ব্যান্ডের ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ক্রয়ের মাধ্যমে তাদের তরঙ্গের পরিমাণ দাঁড়াল ৩৭ মেগাহার্টজ। আর বাংলালিংক ১৮০০ ব্যান্ডের ৫.৬ মেগাহার্টজ ও ২১০০ ব্যান্ডের ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ক্রয় করায় তাদের তরঙ্গের পরিমাণ দাঁড়াল ৩০.৬ মেগাহার্টজ। তরঙ্গের প্রতিযোগিতায় গ্রামীণফোন রবির চেয়ে ০.৬ মেগাহার্টজ বেশি।
ফোরজি সিম ও স্মার্টফোনেওফোরজি সেবা নেই
শুধু ফোরজি ফোন থাকলেই আপনি ফোরজি সেবা ব্যবহার করতে পারবেন না। আবার ফোরজি সিম থাকলেও সম্ভব নয়। প্রথমেই আপনার ফোনটিতে ফোরজি চলবে কিনা তা চেক করে নিতে পারেন। এ জন্য ফোনের ইউজার্স ম্যানুয়াল অথবা অনলাইনে জিসএমএরিনা হতে ফোনের নেটওয়ার্ক কানেক্টিভিটির তথ্য দেখতে পারবেন। যদি ফোনটি এফডিডি-এলটিই ৯০০ বা ১৮০০ বা ২১০০ মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সি সমর্থন করে তা হলে তাতে ফোরজি চলবে, নতুবা নয়। এবার যদি দেখেন ফোনটিতে ফোরজি চলবে না। সেটা কেন? উত্তর এক কথায়, স্মার্টফোনটি ফোরজি সমর্থিত করে তৈরি করা হয়নি। কিন্তু ফোরজি সিম নিয়েছেন, হ্যান্ডসেট ফোরজি সমর্থিত করে তৈরি তারপরও দেশে ফোরজি চলছে না! সে ক্ষেত্রে? আসলে ফোরজি নেটওয়ার্কের মাঝে বেশ কিছু ধরন ও সংস্করণে পার্থক্য রয়েছে। আর এর ফলে ফোন ফোরজি সমর্থিত হলেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীরা বাংলাদেশে ফোরজি ব্যবহার করতে নাও পারেন।
ফোরজি নেটওয়ার্কের টেকনিক্যাল নাম এলটিই। এ নেটওয়ার্কের দুটি ধরন রয়েছে। একটি টিডি এলটিই অন্যটি এফডিডি এলটিই। বাংলাদেশে চালু করা হচ্ছে এফডিডি এলটিই। ফলে যারা টিডি এলটিই সেবার দেশগুলো থেকে আনা ফোন ব্যবহার করছেন তারা ফোরজি সেবা পাবেন না। ফোরজি সেবা দেয়ার জন্য এফডিডি এলটিই নেটওয়ার্কের রয়েছে বেশ কিছু ফ্রিকোয়েন্সি। বাংলাদেশে ৯০০, ১৮০০ ও ২১০০ মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সিতেই ফোরজি সেবা দেবে অপারেটররা। ফলে যেসব ফোন ৯০০, ১৮০০, ২১০০ মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সিতে ফোরজি সমর্থন করে শুধু সেগুলোই ফোরজি সেবা নিতে পারবে। আর এই তিনটি ফ্রিকোয়েন্সি ও ব্যান্ড ইউরোপে বহুল প্রচলিত। ফলে বলা যায়, ইউরোপীয় সংস্করণের ফোনগুলোতে ফোরজি ব্যবহার করা যাবে। তবে চীনা সংস্করণগুলো এফডিডিএলটিই সমর্থন না করায় তাতে দেশে ফোরজি চলবে না। আবার আমেরিকা থেকে আসা ফোনগুলোর মাঝে সবগুলো সংস্করণ ফোরজি সেবা দিতে পারবে না। তবে যারা বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আমদানি করা ফোরজি সমর্থিত স্মার্টফোন কিনেছেন তাদের চিন্তার কিছু নেই। এসব ফোনে সরাসরি ফোরজি কাজ করবে।
বাংলাদেশে ফোরজি সুবিধা সহসাই মিলছে না আইফোন ফোন ব্যবহারকারীদের। বাংলাদেশের কান্ট্রি কোডে আইফোনের ফোরজি সেবা সংক্রান্ত কারিগরি সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে ব্যবহারকারীদের। আইফোন কর্তৃপক্ষ মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোকে জানিয়েছে, এ জন্য আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগতে পারে। তবে আইফোনের ক্ষেত্রেও যে মডেলগুলো ৯০০, ১৮০০, ২১০০ মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সিতে ফোরজি সেবা সমর্থন করবে সেগুলো ফোরজিতে কাজ করবে। ফোনের পেছনে থাকা মডেল নম্বর অনুযায়ী সেটি অনলাইনে জানা যাবে। মডেল নম্বরটি Axxxx এমন হবে।
ফোরজিতে কী কী সুবিধা পাওয়ার কথা
ফোরজির মূল সুবিধা এই নেটওয়ার্কে সর্বোচ্চ গতিতে তথ্য আদান-প্রদান করা সম্ভব। বলাই হচ্ছে, এর গতি হবে সর্বনিু ১০০ মেগাবাইট। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে হাই ডেফিনেশন টেলিভিশন ও ভিডিও কনফারেন্সের সুবিধা পাওয়া সম্ভব। এই প্রযুক্তিতে গ্রাহক সব সময়ই মোবাইল অনলাইন ব্রডব্যান্ডের আওতায় থাকতে পারবে। ফোরজির মাধ্যমে মোবাইলে কথোপকথন ও তথ্য আদান-প্রদানের নিরাপত্তা অনেক বেশি ও শক্তিশালী। ফোরজি মোবাইল গ্রাহকদের ভয়েস মেসেজ, মাল্টিমিডিয়া মেসেজ, ফ্যাক্স, অডিও-ভিডিও রেকর্ডিংসহ নানা ধরনের সুবিধা দেয়। এ ছাড়া এর ডাউনলিংকের ক্ষেত্রে লিংক স্পেকট্রাল এফিসিয়েন্সি প্রতি সেকেন্ডে ১৫ বিট এবং আপলিংকের ক্ষেত্রে ৬ দশমিক ৭৫ বিট হবে।
ধারণা করে হচ্ছে, ফোরজি আসলে আমাদের জীবনধারায় অনেক পরিবর্তন আসবে। কিন্তু দেশের মানুষের ফোরজি নিয়ে এখনো সংশয় কারণটা হল দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাজে এখনও থ্রিজি ঠিকভাবে পৌঁছেনি। যেখানে থ্রিজিই পৌঁছেনি, সেখানে ফোরজি কি আসবে? তবে সময়ই বলে দেবে ফোরজি দেশের মানুষের জন্য কতটুকু আশীর্বাদ বয়ে আনবে।
এখনও প্রস্তুত নয় টেলিটক
বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে ফোরজির চালু হলেও সরকারি মালিকানাধীন মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক এখনও ফোরজি নিয়ে কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি। এর আগে বাংলাদেশে যখন থ্রিজি চালু হয়; তার বেশ আগেই এ সেবা চালু করেছিল টেলিটক। তবে এবার কেন পিছিয়ে টেলিটক? সংসদে সম্প্রতি সরকারি দলের সদস্য দিদারুল আলমের এক লিখিত প্রশ্নের জবাবে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আগামী মে মাসে টেলিটক চতুর্থ প্রজন্মের (ফোরজি) সেবা চালু করবে। টেলিটক নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সব বিভাগীয় শহরে ফোরজি সেবা চালু করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। মন্ত্রী বলেন, গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধিতে টেলিটকের নেটওয়ার্ক পরিধি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ২টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ দুটি প্রকল্প সমাপ্ত হলে উপজেলা পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন তৃতীয় প্রজন্মের (থ্রিজি) নেটওয়ার্ক কভারেজ দেয়া সম্ভব হবে। তিনি বলেন, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে থ্রিজি গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৪ লাখ ১৯ হাজার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন