‘বায়োস্কোপ লাইভ টিভি’ ও ‘বাংলাফ্লিক্স’ নামের দুটি অ্যাপ দেশের স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের কাছে জনপ্রিয়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই অ্যাপগুলোর মাধ্যমে বেহাত হয়ে যেতে পারে ব্যবহারকারীদের গোপন তথ্য। প্রিয়.কমের অনুসন্ধানেও সেই বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উভয় অ্যাপই দেশের দুটি মোবাইল অপারেটরের। এর মধ্যে বায়োস্কোপ লাইভ টিভি অ্যাপটি গ্রামীণফোনের। আর বাংলাফ্লিক্স বাংলালিংকের।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু এই অ্যাপ নয়, টেলিকম অপারেটরদের অন্য অ্যাপগুলোও ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
বায়োস্কোপ লাইভ টিভি
গুগল প্লে-স্টোর ঘেঁটে দেখা যায়, প্লে-স্টোর থেকে গ্রামীণফোনের বায়োস্কোপ লাইভ টিভি অ্যাপটি ১০ লাখের বেশি ডাউনলোড হয়েছে। অ্যাপটির মাধ্যমে ৪০টির বেশি দেশি ও বিদেশি টিভি চ্যানেল দেখাসহ বাংলা সিনেমা ও অন্য নাটক দেখা যায়। ইনস্টলের সময় অ্যাপটি ১৭টি বিষয়ে ব্যবহারকারীর কাছ থেকে অনুমতি চেয়ে থাকে।
ক্যালেন্ডার
অ্যাপটি প্রথমেই ব্যবহারকারীর থেকে ক্যালেন্ডারের অনুমতি চেয়ে থাকে। অ্যাপটি ইংরেজিতে যে অনুমতি চেয়ে থাকে এর বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ব্যবহারকারীর ক্যালেন্ডার ইভেন্ট ও গোপন তথ্য পড়তে পারবে। সেই সঙ্গে অ্যাপটি ক্যালেন্ডার ইভেন্ট সংযোজন বা পরিবর্তন করতে পারবে এবং ব্যবহারকারীকে জানানো ছাড়াই তথ্য মেইল করতে পারবে। অর্থাৎ, অ্যাপটি মোবাইলে থাকা ক্যালেন্ডারের তথ্য ইমেইলের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর অগোচরে পাঠাতে সক্ষম।
অ্যাপ ডেভেলপাররা বলেন, এই অ্যাপটি বিনোদনবিষয়ক। তাই এটি ক্যালেন্ডার ইভেন্টের এক্সেস পারমিশন চেয়ে থাকে। এ ছাড়া এটি নতুন কোনো ইভেন্টের বিষয়ে ব্যবহারকারীকে জানাতে অ্যাড বা মডিফাইয়ের অ্যাক্সেস চেয়ে থাকে।
লোকেশন
অ্যাপটি লোকেশনভিত্তিক পারমিশন চেয়ে থাকে। এর মাধ্যমে অ্যাপটি ব্যবহারকারীর আনুমানিক বা সুনির্দিষ্ট স্থান সনাক্ত করতে সক্ষম।
এসএমএস
এসএমএস বা এমএমএস পারমিশনের মাধ্যমে অ্যাপটি মোবাইলে আসা মেসেজ বা মাল্টিমিডিয়া মেসেজ পড়তে বা এডিট করতে সক্ষম। ফলে অ্যাপটি মোবাইলে থাকা মেসেজ পড়তে পারে এবং তা ডিলিটও করতে পারে।
ফটো/মিডিয়া/ফাইলস
ফটো বা মিডিয়া ফাইলস পারমিশনের মাধ্যমে এটি ইউএসবি স্টোরেজে থাকা তথ্য পড়তে, মডিফাই বা ডিলেট করতে সক্ষম।
অন্যান্য
এসব পারমিশন ছাড়াও অ্যাপটি চলার জন্য ওয়াই-ফাইয়ের তথ্য সংগ্রহ, ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ, পুরো নেটওয়ার্ক এক্সেস নেওয়াসহ স্লিপ মুড থেকে ডিভাইসটিকে বিরত রাখতে সক্ষম।
বাংলাফ্লিক্স
বাংলালিংকের বাংলাফ্লিক্স অ্যাপটি এক লাখের বেশি স্মার্টফোন ব্যবহারকারী ব্যবহার করে থাকেন। অ্যাপটি বায়োস্কোপ লাইভ টিভির মতোই কাজ করে থাকে। এর মাধ্যমে গান শোনা থেকে শুরু করে ভিডিও দেখা যায়। অ্যাপটি ইনস্টলের সময় ১৫টি বিষয়ে গ্রাহকের অনুমতি চেয়ে থাকে।
ফোন
অ্যাপটি প্রথমেই মোবাইল ফোনের বর্তমান অবস্থা এবং আইডেনটিটি জানার অনুমতি চেয়ে থাকে, যা অ্যাপটি চলার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়ে থাকে।
ক্যামেরা
এটি ছবি বা ভিডিও করার সক্ষমতার জন্যও অনুমতিও চেয়ে থাকে। এই অনুমতির ফলে অ্যাপটি চালু থাকা অবস্থায় ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে পারবে।
মাইক্রোফোন
অ্যাপটি অডিও কল রেকর্ডের অনুমতি চেয়ে থাকে। ফলে অ্যাপটি ব্যবহারকারীর কথা যেকোনো সময় রেকর্ড করার সক্ষমতা অর্জন করে।
অন্যান্য
অ্যাপটি বায়োস্কোপের মতো ব্যবহারকারীর এসএমএস ও এমএমএস পড়া এবং সম্পাদন করা, মোবাইলে থাকা ছবি বা তথ্য সংশোধন বা মুছে ফেলতে সক্ষমতা চেয়েও অনুমতি চেয়ে থাকে। এ ছাড়াও অ্যাপটি নিজের চালুর সুবিধার্থে ডিভাইসের আইডি ও মোবাইলের কলের তথ্য নিতে সক্ষম।
এসব অ্যাপ ছাড়াও অন্যান্য টেলিকম অপারেটর যেমন রবির ‘মাই স্পোর্টস’, ‘মাই রবি’, ‘রবি টিভি’ এবং টেলিটকের ‘টেলিফ্লিক্স’ অ্যাপেও মোবাইলের বিভিন্ন অ্যাক্সেস চেয়ে অনুমতি নিয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে মোবাইলের স্টোরেজ সিস্টেমে কোনো ফাইল মডিফাই করা বা ডিলেট করাসহ অন্য বিষয়গুলো।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন
অ্যাপ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কোন অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের তথ্য নেওয়ার জন্য বানানো হয়েছে আর কোন অ্যাপটি আসলেই কাজের জন্য, তা বোঝা কঠিন। তবে অ্যাপ ডাউনলোডের সময় ব্যবহারকারীদের অনুমতি দেওয়ার সময় তা পড়ে এবং বুঝে পারমিশন দেওয়ার পক্ষে মত দেন তারা।
তাজুল ইসলাম নামের এক অ্যাপ ডেভেলপার বলেন, ‘অ্যাপ ইনস্টলের সময় ব্যবহারকারী অ্যাপগুলোকে যেসব পারমিশন দিয়ে থাকেন, এসব ওই অ্যাপের জন্য প্রয়োজন হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে ওই অ্যাপ ডেভেলপার চাইলে ওই পারমিশনের অপব্যবহারও করতে পারেন। যেমন: যে অ্যাপ ছবি তোলার পারমিশন পেয়ে যায়, ওই অ্যাপ চালু থাকা অবস্থায় অ্যাপটি ছবি তুলতে পারে। আর এই ছবি যদি স্টোরেজে রাখা হয়, তাহলে অ্যাপ ডেভেলপার ছবি মডিফাই বা ডিলিট পারমিশনের মাধ্যমে ওই ছবি বেহাতও হতে পারে।
আবার অনেক অ্যাপই ব্যবহারকারীর কন্টাক্ট নম্বরের এক্সেস চেয়ে থাকে। যদি ওই অ্যাপ ব্যবহারকারী তাকে এই এক্সেস দিয়ে থাকে, তাহলে অ্যাপ ডেভলপার কন্টাক্ট নম্বরের তথ্য পেয়ে যাবে, যা পরবর্তীতে অন্য কাজেও ব্যবহার হতে পারে।’
আশরাফ আবির নামের এক অ্যাপ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘গুগল প্রাইভেসির দিকে সর্বোচ্চ নজর দেয়। তারা নানা রকম শর্ত জুড়ে দেয়। যারা অ্যাপ সাবমিট করে, তারাও জানিয়ে দেয় তারা কী কী ব্যবহারের অনুমতি চাইছে। কিন্তু আমাদের দেশে অ্যাপ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব। তারা না বুঝেই, পড়েই একটি অ্যাপকে সব কিছুর পারমিশন দিয়ে দেয়।
তবে গুগলে যে অ্যাপ রয়েছে তার কোনো কোনোটি আমাদের জন্য অনেক দরকারি হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা জানি না কোন অ্যাপটি আমাদের তথ্য নেওয়ার জন্য বসে রয়েছে, আর কোনটি আমাদের সাহায্য করার জন্য।’
আশরাফ আবির আরও বলেন, ‘ফেসবুক তো ইচ্ছে করে তথ্য পাচার করেনি, তাদের কাছ থেকে তথ্য বেহাত হয়ে গেছে। ফলে আমরা যে অ্যাপগুলোর ব্যবহার করছি, সেই অ্যাপগুলোর মাধ্যমে তথ্য বেহাত হবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। দেখা যাবে, যদি এই পারমিশনের বিষয়টি বাংলায় লেখা থাকত, তাহলে সহজে কেউ অ্যাপই ডাউনলোড করত না। তবে আমাদের দেশে না বুঝে অ্যাপ ইনস্টলের হার না কমে আর আমরা যদি সচেতন না হই, তবে ভবিষ্যতে আমরা বড় বিপদে পড়ব।’
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভির হাসান জোহা বলেন, ‘একজন অ্যাপ ডেভলপারের কাছে ডেটা ইম্পরট্যান্ট। যখন কোনো অ্যাপ আমরা ইনস্টল করি, তখন অ্যাপটি আমাদের কাছ থেকে নানা পারমিশন চেয়ে থাকে। আমরা যদি অ্যাপটিকে সেই পারমিশন না দেই, তাহলে অ্যাপটি কাজ করবে না। এ ছাড়া নানা অ্যাপে ব্যাকডোর সিস্টেম থাকে। এর ফলে অ্যাপটি মনিটরিং করতে পারে, সঙ্গে ডেটাও চুরি করতে পারে। তাই আমার মতে, মোবাইল ডিভাইসে সংবেদনশীল তথ্য-ছবি না রাখাই ভালো।’
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, বিশ্বের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক বর্তমানে তথ্য পাচারের অভিযোগে সংকটময় অবস্থায় রয়েছে। এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, সেটি গোপনভাবে ব্যবহারকারীর কল ও মেসেজের তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ফেসবুকের বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগের জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ। কিন্তু এর আগে জাকারবার্গও জানতেন না তাদের অ্যাপের মাধ্যমে তথ্য বেহাত হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে।
গ্রামীণফোন ও বাংলালিংকের বক্তব্য
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে ই-মেইলে বলা হয়, ‘‘বায়োস্কোপে ‘শো রিমাইন্ডার’ অপশনটি ইউজারকে মনে করিয়ে দেয় তার প্রিয় প্রোগ্রামটির কথা। ক্যালেন্ডারে প্রবেশের অনুমতি গুগলের নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী চাওয়া হয়।
যেহেতু আমরা বায়োস্কোপের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময়সূচি গ্রাহককে জানিয়ে থাকি, সে ক্ষেত্রে গ্রাহক তার ক্যালেন্ডারে ভালো লাগার অনুষ্ঠানটির সময় জানতে চান কি না, সেটির জন্য এই অনুমোদন নেওয়া হয়।’’
এই পারমিশনের মাধ্যমে গ্রামীণফোন কী গুপ্তচরবৃত্তির আশ্রয় নিচ্ছে কি না জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘গ্রামীণফোন স্বচ্ছতার সাথেই ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। গ্রাহকের অনুমোদনের বাইরে এখানে অন্য কোনো কিছু করার সুযোগ নেই।
ইউজারের অনুমতির বাইরে কোনো তথ্য গুগল ক্যালেন্ডার কোনো অ্যাপকে প্রদান করে না। এ ছাড়া এই পারমিশনের মাধ্যমে বায়োস্কোপ অ্যাপ ব্যবহারকারীর প্রাইভেসিতে কোনো প্রভাব পড়বে না, বরং তার প্রাইভেসিতে যেন কোনো প্রভাব না পড়ে, তা-ই অনুমোদন চাওয়া হয়।’
একই প্রশ্নের উত্তরে বাংলালিংকের পক্ষ থেকে ই-মেইলে বলা হয়, ‘বাংলালিংকের প্রতিটি কার্যক্রম বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) এবং বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত আইন ও নীতিমালা অনুসরণ করে পরিচালনা করা হয়। এই ক্ষেত্রেও নীতিমালা অনুসরণের কোনো ব্যত্যয় ঘটার প্রশ্ন নেই।’
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন