সেদিন নিজের মনের ভাষায় সাড়া না দিলে হয়তো গতকাল গভীর সমুদ্রে জাহাজে বসে ভারত-পাকিস্তান স্বপ্নের ফাইনাল ম্যাচের খবর রাখতেন। নৌবাহিনীর পোশাক পরে ইউটিউবে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর দ্বৈরথ দেখতেন। ভাগ্যিস 'নৌ সেনা' হননি ফখর জামান। হয়েছেন ক্রিকেটের সৈনিক। হয়েছেন হাই ব্যাক লিফটের দুর্দান্ত এক ব্যাটসম্যান। মাত্র চারটি ওয়ানডে খেলেই ক্রিকেট দুনিয়ায় ঝড় তুলেছেন ২৭ বছর বয়সী পাকিস্তানের এ ওপেনার। গতকাল কেনিংটন ওভালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন নেভিম্যান ফখর। বিশ্বকাপের পর আইসিসির দ্বিতীয় মর্যাদাকর এ টুর্নামেন্টের ফাইনালে সেঞ্চুরি করেই ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেছেন ফখর জামান। প্রথম পাকিস্তানি হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়লেন তিনি। নো বলে জীবন পাওয়া ফখরের ঝড়ো ইনিংসটি থামে ১১৪ রানে। তার ব্যাটে চড়ে ভারতের বিপক্ষে টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে ৪ উইকেটে ৩৩৮ রান সংগ্রহ করে পাকিস্তান। ফাইনালে ভারতকে ১৮০ রানে হারিয়ে শিরোপা জিতে তারা।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে নৌ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল বলেই আবার ফিরে আসেন। মনোযোগ দেন ক্রিকেটে। কিন্তু নৌবাহিনীতে গিয়েছিলেন বলেই ফখর জামানের ডাক নাম হয়ে যায় 'সোলজার'। এবার বাইশ গজে সত্যিকার যোদ্ধা হিসেবে আবির্ভাব তার। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেই উত্থান ফখর জামানের। আহমেদ শেহজাদের জায়গায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক ঘটে। সেই ম্যাচে ৩১ রানের ইনিংস খেলে নতুন কিছুরই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মারদান শহরে বেড়ে ওঠা এ ক্রিকেটার। এরপর শ্রীলংকার বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি। সেমিফাইনালে ইংলিশদের বিপক্ষেও পঞ্চাশ রানের ইনিংস খেলে দলকে নিয়ে যান স্বপ্নের ফাইনালে। টানা দুটি ফিফটি। ফাইনালের জন্যই হয়তো নিজের সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলেন ফখর।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। সেটাও ফাইনালে। প্রতিপক্ষ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত। সেঞ্চুরির মাহাত্ম্যটাই তো আলাদা। এই সেঞ্চুরি দিয়েই নিজেকে চেনালেন 'অচেনা' ফখর। আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে ভারতের বিপক্ষে তৃতীয় পাকিস্তানি হিসেবে একশ' রান করেছেন তিনি। এর আগে সাঈদ আনোয়ার ২০০৩ বিশ্বকাপে ও শোয়েব মালিক ২০০৯ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তিন অঙ্কের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন। অথচ রোববার মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখতেন ফখর। পাকিস্তানের ইনিংসের চতুর্থ ওভারেই জাসপ্রিত বুমরাহর বলে উইকেটরক্ষক মহেন্দ্র সিং ধোনির হাতে ক্যাচ দেন তিনি। কিন্তু বলটা নো হওয়ায় বেঁচে যান ফখর। এরপর এলোপাতাড়ি কয়েকটি শট খেলে হাফ চান্স দিয়েছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রোকের ফুলঝুরি ফোটাতে থাকেন তিনি। প্রথম হাফ সেঞ্চুরি পেতে খেলেন ৬০ বল। দ্বিতীয়টি পেতে খেলেছেন মাত্র ৩২ বল। তিন অঙ্কে যান ৯২ বলে। ৩০.১ ওভারে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের প্রথম বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চরি হাঁকানো জামানকে দেখে মনেই হয়নি ফাইনালের স্নায়ুচাপ বলতে কিছু আছে। শতরান করার পর আর বেশিদূর যেতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত ১০৬ বলে ফেরেন ১২টি চার এবং তিনটি ছক্কায় ১১৪ রান করে।
ইউনিস খানের শহরে মারদানে জন্ম নেওয়া ফখর জামান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করার পুরস্কার হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দলে সুযোগ পান। দিনের পর দিন পাকিস্তানের 'পুরস্কারহীন' ঘরোয়া ক্রিকেটে সংগ্রাম করেছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার ব্যাটিং গড় চমক দেওয়ার মতোই। ২০১২ সালে লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ার পরের বছরই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয় তার। লিস্ট 'এ'র ব্যাটিং গড় ৫০.১৮। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও মন্দ নয়; ৪২.০১। পরিশ্রমের বিকল্প যে কিছুই হয় না_ এই সত্যবাক্য নতুন করে মনে করিয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ ঘটে ফখর জামানের।
ক্যারিয়ারের শুরুতেই বিশ্বমঞ্চে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন এই 'যোদ্ধা'।
স্কোর কার্ড
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি
ভারত-পাকিস্তান
ফাইনাল
কেনিংটন ওভাল, লন্ডন
টস :ভারত
পাকিস্তান ইনিংস রান বল ৪ ৬
আজহার রান আউট ৫৯ ৭১ ৬ ১
ফখর ক জাদেজা ব পান্ডিয়া ১১৪ ১০৬ ১২ ৩
বাবর ক যুবরাজ ব যাদব ৪৬ ৫২ ৪ ০
মালিক ক যাদব ব ভুবনেশ্বর ১২ ১৬ ০ ১
হাফিজ অপরাজিত ৫৭ ৩৭ ৪ ৩
ইমাদ অপরাজিত ২৫ ২১ ১ ১
অতিরিক্ত (লেবা ৯, ও ১৩, নো ৩) ২৫
মোট (৪ উইকেট; ৫০ ওভার) ৩৩৮
উইকেট পতন : ১/১২৮, ২/২০০, ৩/২৪৭, ৪/২৬৭
বোলিং :ভুবনেশ্বর ১০-২-৪৪-১, বুমরাহ ৯-০-৬৮-০, অশ্বিন ১০-০-৭০-০, পান্ডিয়া ১০-০-৫৩-১, জাদেজা ৮-০-৬৭-০, যাদব ৩-০-২৭-১
ভারত ইনিংস রান বল ৪ ৬
রোহিত এলবি আমের ০ ৩ ০ ০
ধাওয়ান ক সরফরাজ ব আমের ২১ ২২ ৪ ০
কোহলি ক শাদাব ব আমের ৫ ৯ ০ ০
যুবরাজ এলবি শাদাব ২২ ৩১ ৪ ০
ধোনি ক ইমাদ ব হাসান ৪ ১৬ ০ ০
যাদব ক সরফরাজ ব শাদাব ৯ ১৩ ২ ০
পান্ডিয়া রান আউট ৭৬ ৪৩ ৪ ৬
জাদেজা ক বাবর ব জুনায়েদ ১৫ ২৬ ০ ০
অশ্বিন ক সরফরাজ ব হাসান ১ ৩ ০ ০
ভুবনেশ্বর অপরাজিত ১ ৮ ০ ০
বুমরাহ ক সরফরাজ ব হাসান ১ ৯ ০ ০
অতিরিক্ত (লেবা ২, ও ১) ৩
মোট (অলআউট; ৩০.৩ ওভার) ১৫৮
উইকেট পতন : ১/০, ২/৬, ৩/৩৩, ৪/৫৪, ৫/৫৪, ৬/৭২, ৭/১৫২, ৮/১৫৬, ৯/১৫৬, ১০/১৫৮
বোলিং: আমের ৬-২-১৬-৩, জুনায়েদ ৬-১-২০-১, হাফিজ ১-০-১৩-০, হাসান ৬.৩-১-১৯-৩, শাদাব ৭-০-৬০-২, ইমাদ ০.৩-০-৩-০, ফখর ৩.৩-০-২৫-০।
ফল :পাকিস্তান ১৮০ রানে জয়ী।
ম্যাচসেরা :ফখর জামান (পাকিস্তান)
টুর্নামেন্টসেরা :হাসান আলি (পাকিস্তান)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন