টি-২০এর পর বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের দায়িত্বও দেয়া হলো বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের কাঁধে। এটা অবশ্যই খুব আনন্দের সংবাদ। দলের সেরা পারফরমারের কাঁধেই থাকা উচিত নেতৃত্বের ভার। কিন্তু নেতৃত্ব নিছক পারফরম্যান্স নয়, আরো বেশি কিছু। সেরা পারফরমার হলে নেতৃত্ব দেয়াটা সহজ হয়, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। ক্রিকেটে ‘ক্যাপ্টেন্স নক’বলে একটা টার্ম আছে। অধিনায়ক ভালো ইনিংস খেললে তার ক্ষেত্রে এই টার্মটি ব্যবহার করা হয়। তবে সেরা পারফরমার না হয়েও সেরা অধিনায়ক হওয়ার উদাহরণ আছে ভুরি ভুরি। তাই বলছিলাম, অধিনায়কত্ব নিছক পারফরম্যান্স নয়, আরো বেশি কিছু।
.
সেরা পারফরমার না হয়েও যে সেরা অধিনায়ক হওয়া যায়, তার টাটকা উদাহরণ কিন্তু আমাদের সবার চোখের সামনেই আছে। অনেকদিন ধরেই মাশরাফি বিন মোর্তাজা দলের সেরা পারফরমার নন, কিন্তু শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের একজন মাশরাফি। নেতৃত্বের সব গুণ তার মধ্যে আছে। তিনি স্বার্থপর নন, তিনি সবাইকে নিয়ে চলতে পারেন, খারাপ সময়ে দলের ক্রিকেটারদের আাগলে রাখেন। সতীর্থদের কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনার কৌশল তার জানা।
সবার সাথে মিলে আড্ডায়, হইচইয়ে চাঙ্গা রাখেন দলকে। ভালোবাসা দিয়ে মাশরাফি শুধু সতীর্থদের নয়, জয় করে নিয়েছেন কোটি বাঙালির হৃদয়। তাই বলছিলাম নেতৃত্ব দেয়ার বিষয়টা একদম আলাদা। ক্রিকেটে একটা বিষয় আমার খুব খারাপ লাগে। ক্রিকেট মূলত অধিনায়ককেন্দ্রিক খেলা। ভালো একজন অধিনায়কই বদলে দিতে পারে খেলার চিত্র। কিন্তু অনেক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী অধিনায়কের বিদায়টা হয়েছে বড় করুণভাবে। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশে অধিনায়কের করুণ বিদায়ের চিত্র দেখেছি আমরা।
এই যেমন মুশফিকুর রহিম এখন থেকে দলের একজন সাধারণ সদস্য। কিন্তু বিদায়ের সময় তার অতীত অবদানের কথা আমরা মনে রাখিনি। অধিনায়কের বিদায়টা আরো আনুষ্ঠানিক, আরো সম্মানের হতে পারতো, হওয়া উচিত ছিল। বিদায়ের সময় তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত ছিল। কিন্তু জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রের মত ক্রিকেটেও- গাঙ পার হইলেই মাঝি শালা হয়ে যায়। মুশফিকুর রহিমের দিন যে ফুরিয়ে আসছিল সেটা অবশ্য টের পাওয়া যাচ্ছিল আরো আগে থেকেই।
শ্রীলঙ্কা সফরের সময় থেকেই বোর্ড এবং কোচের সাথে তার বিরোধটা স্পষ্ট হয়ে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে সেটা আরো তীব্র ও প্রকাশ্য হয়। অধিনায়ক হলেও তার ইচ্ছার কোনো দাম ছিল না দলে। এমনকি কিপিং করতে চেয়েও পারেননি।ব্যাটিং অর্ডারেও তার পছন্দের মূল্য ছিল না। টসের সিদ্ধান্তও দিতেন কোচ। এমনকি অধিনায়ক থাকার সময়ও অনেকে ম্যাচে ফিল্ডিং সাজাতেন অন্য কেউ। তার এইসব ক্ষোভের কথার অনেককিছুই প্রকাশ্যে বলেছেনও। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের শেষ ইনিংসে মুশফিক ব্যাট করতে নামার সময় ফেসবুকে আমি আশঙ্কা করে লিখেছিলাম, মুশফিক সম্ভবত অধিনায়ক হিসেবে তার শেষ ইনিংসটি খেলতে নামছেন।
সেই আশঙ্কাটাই সত্যি হলো। তবে তার বিদায়টা আরো সম্মানজনকভাবে হতে পারতো। মুশফিকের পারফরম্যান্স নিয়ে কোনো সংশয় না থাকলেও তার অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন ছিল বরাবরই। মুশফিকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তিনি অনেক বেশি রক্ষণাত্মক। টি-২০এর জমানায় এখন টেস্ট জিততে হলেও আরো বেশি আক্রমণাত্মক মানসকিতা চাই। তাছাড়া মুশফিক অনেক বেশি আবেগাক্রান্ত। নিজের বা দলের খারাপ পারফরম্যান্সে মুষড়ে পড়েন, কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। যা দলের মনেোবলকেও ক্ষতি করে। এতকিছুর পরও মুশফিকই বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল টেস্ট অধিনায়ক।
সফলতম টেস্ট অধিনায়কের এমন করুণ বিদায়ে ভবিষ্যতে কেউ অধিনায়ক হতে চাইবেন কিনা কে জানে। শুধু অধিনায়ক নন, বাংলাদেশে দেশী-বিদেশী কোচদের বিদায়টাও যথাযথ হয় না। মহিন্দর অমরনাথ থেকে শুরু করে গর্ডন নিজ, সর্বেসর্বা হাথুরুসিংহে; কারো বিদায়ই ভালো হয়নি। তবে দায়টা সবসময় একপাক্ষিক নয়। এই যেমন হাথুরুসিংহের মত একজন্ পেশাদার কোচ যে অপেশাদার স্টাইলে চাকরি ছাড়লেন, তা রীতিমত লজ্জার। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষে তিনি ই-মেইলে চাকরি ছাড়ার কথা জানিয়ে দেন।
এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের রিপোর্ট দেননি এখনও। হাথুরু বাংলাদেশ ক্রিকেটকে সাফল্যের রাজপথটা চিনিয়ে দিয়েছেন, দলে শৃঙ্খলা এনেছেন; একথা যেমন ঠিক; তেমনি তিনিই দলের স্বৈরাচারী সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিলেন, এটাও তো ঠিক। তিনিই দলের কোচ, তিনিই অধিনায়ক, তিনিই প্রধান নির্বাচক। সবকিছু তিনি একাই। বোর্ড সভাপতিও তাকে ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে রেখেছিলেন। এতকিছু দিযেও তার মন পেলেন না পাপন। আসলে পাপন হয়তো পেয়েছিলেন, কিন্তু দলের সিনিয়র ক্রিকেটাররা কোচের মন জয় করতে পারেননি।
দলে শৃঙ্খলা আনবেন, ঠিক আছে। কিন্তু সারাক্ষণ বেত হাতে মাস্টারি করলে এক ঝাঁক তারকাকে এক সাথে মিলিয়ে রাখা সত্যি কঠিন। শাসন করতে হলে আপনাকে ভালোও বাসতে হবে। শুধু ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না। হাথুরু ক্রিকেটারদের ভালোবাসতেন না, এমন অভিযোগ করা যাবে না। কিন্তু সমস্যা হলো তার ভালোবাসাটা পেয়েছে হাতে গোনা দুয়েকজন। হাথুরুর ব্যাপারে আমার সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল দলে তার অনুরাগ-বিরাগের তীব্র প্রকাশ। অপছন্দের ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারের বারোটা বাজিয়ে দেয়াই যেন তার বিনোদন। আর এখন সবচেয়ে বড় অভিযোগ পদত্যাগে অপেশাদারিত্ব।
মুশফিক যতই রক্ষণাত্মক হোন, হাথুরু যতই অপেশাদার হোন; কিন্তু তারা সেই সুযোগটা পেয়েছেন কোথায়? বোর্ডের লাই পেয়েই তারা এমন অপেশাদার আচরণ করতে পেরেছেন। তাই অন্য সবার কাছ থেকে পেশাদারিত্ব্ আশা করলে, সবার আগে বোর্ডের আরো পেশাদার আচরণ করা উচিত। বাংলাদেশ ১৭ বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেট খেলে। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ রীতিমত সমীহ জাগানো শক্তি। তাই এর বোর্ডকেও আরো পেশাদার হতে হবে। কিন্তু বোর্ডের আচরণ ঠিক পেশাদারসুলভ নয়। হাথুরুর বিদায়টা যেমন চোখে লাগছে, তেমনি তাকে সর্বেসর্বা বানিয়ে দেয়াটাও চোখে লেগেছে। বোর্ডে পেশাদার আবহ থাকলে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না।
হাথুরু ই-মেইলে পদত্যাগ করার ঔদ্ধত্য দেখাতে পারতেন না। বলছিলাম সাকিবের অধিনায়কত্বের কথা। বাংলাদেশ যেমন মাশরাফির মত বিশ্বমানের অধিনায়ক জন্ম দিয়েছে; তেমনি আশরাফুল-তামিমের মত বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান বাংলাদেশেরই। তবে সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা পারফরমার সাকিব আল হাসান। তিনিই আসলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাইনবোর্ড। তাই তার কাঁধে অধিনায়কত্বের ভার তুলে দেয়াটা স্বাভাবিকই মনে হতে পারে।
ইতিমধ্যে মাশরাফিকে সরিয়ে সাকিবকে টি-২০এর অধিনায়ক করা হয়েছে। এবার সরানো হলো মুশফিককে। এখন অপেক্ষা মাশরাফির বিদায়ের। অনেকদিন ধরে বোর্ড আলাদা ফরম্যাটের আলাদা অধিনায়কের কথা বলে আসছিল্। কিন্তু লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে বোর্ড আবার একক অধিনায়কের ফরমুলায় ফিরে যাচ্ছে। তার মানে বোর্ডের আসলে কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান নেই। নিজেদের সুবিধামত তারা তাদের অবস্থান বদলায়।
সাকিব অধিনায়ক হওয়ায় আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ভালো পারফরমার হলেও তার মধ্যে নেতৃত্ব গুণ কতটা আছে সেটা বিবেচনা করা দরকার। সাকিব কিন্তু এই প্রথম বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক হলেন না। এর আগে মাশরাফির ইনজুরির সুবাদে হুট করে অধিনায়ক হয়ে গিয়েছিলেন হোট করেই। কিন্তু সেটা বেশিদিন টেকেনি। সেটা যতটা না পারফরম্যান্স বিবেচনায় তারচেয়ে বেশি অ্যাটিচ্যুডের কারণে।
সকিবের অ্যাটিচ্যুড নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন বোর্ড প্রধান পাপন। প্রশ্ন হলো, এই সময়ে কি সাকিবের অ্যাটিচ্যুড বদলে গেছে? আমার উত্তর হলো, না, অ্যাটিচ্যুড বদলায় তো নাই, বরং আরো খারাপ হয়েছে। পারফরম্যান্সের বিবেচনায় একশোতে একশো পাবেন সাকিব। কিন্তু অ্যাটিচ্যুডে, শৃঙ্খলা, আচরণ- ইত্যাদি সবকিছুতে তিনি মাইনাস পাবেন। এমনকি সাকিবের মত পারফরমারকেও শৃঙ্খলাজনিত কারণে বোর্ড নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। সাকিব পেশাদার। এটা তার পক্ষে বড় যুক্তি হতে পারতো। কিন্তু সাকিব এতটাই পেশাদার যে, সেটাও দলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তারচেয়ে বড় কথা, সাকিব পারফরমার হিসেবে যত ভালো, মানুষ হিসেবে নিজেকে ততটা ভালো প্রমাণ করতে পারেননি। বরং ভক্তদের সাথে মারামারি করে, ক্যামেরার সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে সাকিব বারবার প্রমাণ করেছেন, ভালো মানুষ তো ননই, স্পোর্টস আইডল হওয়ার মত যোগ্যতাও তিনি অর্জন করতে পারেননি।
একজন খেলোয়াড়কে শুধু ভালো খেললেই হয়। কিন্তু অধিনায়ককে ভালো খেলার পাশাপাশি মানুষ হিসেবেও অনুকরণীয় হতে হয়। সাকিবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সময়কার। তখন আমি পরিবর্তনডটকম’এ ‘সাকিবের ক্লান্তি, মুশফিকের ভ্রান্তি’শিরোনামে একটা লেখা লিখেছিলাম। এমনিতে আমরা বছরে একটা দুইটা টেস্ট খেলার সুযোগ পাই। এই যেমন ১০ বছরে সাকিব খেলেছেন মাত্র ৫১টি টেস্ট। যেখানে সাকিবের মাপের প্রতিভার একজন খেলোয়াড় অন্য দেশে জন্মালে অনেক রেকর্ড থাকতো তার মুকুটে।
বাংলাদেশের একজন খেলোয়াড় হয়তো জীবনে একবারই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সুযোগ পাবেন। আর যে কোনো টেস্ট খেলোয়াড়ের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা সফর স্বপ্নের। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকার পিচ, কন্ডিশন, বোলিং শুধু বাংলাদেশ নয়; যে কোনো প্রতিপক্ষের সামর্থ্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়।নিজেদের মাটিতে নিজেদের মত উইকেট বানিয়ে একের পর এক প্রতিপক্ষকে কাবু করায় আনন্দ অবশ্যই আছে, তবে তৃপ্তি নেই। বিরুদ্ধ কন্ডিশনে সেরাদের বিরুদ্ধে সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে পারলেই মেলে পরিপূর্ণ তৃপ্তি।
তাই দক্ষিণ আফ্রিকা সফর বাংলাদেশ দলের জন্য যেমন, ব্যক্তি সাকিবের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা। সেরারা পারফর্ম করবে তো সেরাদের বিপক্ষেই, বিরুদ্ধ কন্ডিশনে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের আগে সাকিব ক্লান্তির কথা বলে টেস্ট ক্রিকেট থেকে ছয় মাসের ছুটি চাইলেন। আরো অবাক করে দিয়ে বোর্ড তা মঞ্জুরও করেছিল। তবে ছয় মাস নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিজের জন্য। তবে বোর্ড বলেছিল, দরজা খোলা, চাইলে সাকিব দলের সাথে যোগ দিতে পারতেন।
কিন্তু বাংলাদেশ যখন দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে হাবুডুবু খাচ্ছিল, তখনও সাকিব দলের সাথে যোগ দেননি। সাকিবের ছুটি নিয়ে আমার মনে একটু খচখচ থাকলেও, মেনে নিয়েছিলাম, এই ভেবে যে সাকিবও মানুষ। তারও ক্লান্তি আাসতে পারে। বাংলাদেশের সব ম্যাচ তো বটেই; ঘুরে ঘুরে বিপিএল, আইপিএল, বিগব্যাশ, সিপিএল, পিএসএল, ইংলিশ কাউন্টি খেলতে হয়। এছাড়া বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, সামাজিকতা ইত্যাদি ইত্যাদি তো আছেই।
খচখচ থাকলেও সাকিবের ছুটিটা আমি মিনে নিতাম, যদি দেখতাম ক্লান্তি দূর করতে সাকিব শিশির আর রাজকন্যাকে নিয়ে কোনো দ্বীপে নিরিবিলি সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু একটু মনে করে দেখুন, ‘ক্লান্তি’দূর করতে ছুটি নিয়ে সাকিব তখন কী করেছেন? তিনি রংপুরে এবং মানিকগঞ্জে অন্তত দুজন আওয়ামী লীগ নেতার নির্বাচনী সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন। যখন শুনি সাকিব ছুটি নিয়ে টেকনাফে শরণার্থী ক্যাম্পে ছুটে গেছেন বা দুর্নীতি দমন কমিশনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে তাদের বিজ্ঞাপনে মডেল হচ্ছেন; ভালোই লাগতো; যদি না দক্ষিণ আফ্রিকায় আমাদের ক্রিকেটের সাফল্যের বেলুন ফুটো হয়ে যেত।
একজন ক্রিকেটার তার জনপ্রিয়তাকে দেশ ও দশের কল্যাণে কাজে লাগাবে। কিন্তু সবকিছু করার আগে তো মূল কাজটা করতে হবে। সাকিবকে ঘুরে ঘুরে নির্বাচনী সমাবেশে বক্তৃতা দিতে বা টেকনাফ যেতে দেখে মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু যখন দেখলাম, সাকিব আল হাসান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ সংক্রান্ত একটি সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছেন, তখন মন খারাপ ক্ষোভে পরিণত হয়েছিল।
বালাদেশের ক্রিকেটাররা যখন দক্ষিণ আফ্রিকার কঠিন পরিবেশে রীতিমত খাবি খাচ্ছে, তখন বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারকে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের উজ্জীবিত করতে দেখলে আমার খারাপ লাগে, কষ্ট হয়। সমস্যাটা এখানেই। সাকিব পেশাদার, তবে একটু বেশি। তার পেশাদারিত্ব তার ক্যারিয়ারকে উজ্জ্বল করে, তার ব্যাংক ব্যালেন্সকে মোটা করে; কিন্তু দলের কোনো কাজে আসে না।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার অনেক এক্সাইটমেন্ট ছিল। অথচ বোর্ডের বেতনভুক্ত খেলোয়াড় সাকিবের মধ্যে সেই এক্সাইটমেন্ট দেখিনি। আসলে ক্রিকেট নিয়ে আমাদের যত দেশপ্রেম, আবেগ, এক্সাইটমেন্ট; ক্রিকেটারদের ততটা নেই, থাকা সম্ভবও নয়। কারণ এটা তাদের প্রতিদিনের কাজ।
যেহেতু আমরা টেস্ট খেলার সুযোগ কম পাই, তাই সেটাই থাকার কথা প্রায়োরিটি লিস্টের টপে। কিন্তু বেদনার সাথে দেখলাম বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডারের প্রায়োরিটি লিস্ট আমাদের ভাবনার সমান্তরাল নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ দলের পারফারম্যান্স দেখে আমি বারবার সাকিবকে মিস করেছি।
সাকিব থাকলেই বাংলাদেশ জিতে যেতো, ব্যাপারটা এমন নয়, তবে সাকিব মানেই টু ইন ওয়ান। অন্য অনেকের মত সাকিব মিনি অলরাউন্ডার নন। তিনি বিশ্বের এক নাম্বার অলরাউন্ডার। একইসঙ্গে তিনি দলের সেরা বোলার এবং সেরা ব্যাটসম্যানও। তিনি না থাকলে দলে দুজন খেলোয়াড় নিতে হয়। কিন্তু সেই দুজন মিলেও সাকিবের সমান পারফরম্যান্স দিতে পারেন না।
সাকিব আসলে কেন ছুটি নিয়েছিলেন? ক্লান্তির কারণে যে নয়, তা তো তার ছুটির সময়কার কার্যকলাপ দেখেই বোঝা গেছে। আমার ধারণা, সাকিব আসলে দলে তার গুরুত্বটা হাতে কলমে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, দেখো আমি না থাকলে তোমাদের কী অবস্থা হয়। এবং সেটা বেশ ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেনও।
কেন বাংলাদেশ ছেড়েছেন, এ নিয়ে হাথুরু সরাসরি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেননি। বোর্ড প্রধান তার সাথে কথা বলার পর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন হাথুরুর ক্ষোভের কথা। হাথুরুর ইঙ্গিত সিনিয়র খেলোয়াড়দের সাথে তার দূরত্ব।আরো নির্দিষ্ট করে বলেছেন সাকিবের ছুটির কথা। সাকিবের মত একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের দেশের জন্য খেলতে না চাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি হাথুরু। খুবই যৌক্তিক চাওয়া।
দেশের হয়ে টেস্ট খেলতে যার ক্লান্তি আসে; দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে না খেলার কারণে যেখানে সাকিবের শাস্তি হওয়ার কথা, সেখানে পরের সিরিজেই তিনি অধিনায়ক! দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট খেলার চেয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের উদ্বুদ্ধ যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়; তার কাঁধে নেতৃত্বের দায়িত্বটা বড্ড বেমানান ঠেকে।
আগেও বলেছি, এখনও বলছি; সাকিবের পারফরম্যান্স নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই। কিন্তু দেশের প্রতি তার নিবেদন নিয়ে আমার নয়, আরো অনেকের সংশয় আছে। সেই সংশয়টা জেগেছে তার নানা সময়ের কর্মকাণ্ডেই। তারপরও আমি আশা করবো, নেতৃত্ব বদলে দেবে সাকিবকে। আশা করি ভালো পারফরমারের মত ভালো নেতাও হয়ে উঠবেন তিনি। আশায়ই বসতি গড়তে চাই।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাফল্যের জন্য মাশরাফির অনুপ্র্রেরণাদায়ী নেতৃত্ব, হাথুরুর কৌশলী কোচিং অবশ্যই কৃতিত্ব পাবে; তবে আমার বিবেচনায় সবচেয়ে বড় কারণ- মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহর মত ৫ জন সিনিয়র ক্রিকেটারের দীর্ঘদিন একসাথে খেলা এবং ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করা।
কিন্তু মাশরাফিকে টি-২০ থেকে বাদ দিয়ে, শ্রীলঙ্কা সফরে মাহমুদুল্লাহকে নিয়ে ছেলেখেলা খেলে, মুশফিকের কাছ থেকে টেস্ট অধিনায়কত্ব কেড়ে নিয়ে সেই সেরা ৫-এর মনোবলে বড় একটা ধাক্কা কিন্তু আমরা দিয়েই দিয়েছি। সেই ধাক্কা সামলে তারা কতটা পারফর্ম করতে পারবে, তা নিয়ে আমার মধ্যে একটা সংশয় থেকেই যাচ্ছে। আমি অতি আশাবাদী মানুষ, তবু হতাশার একটা চোরা স্রোত আমাকে শঙ্কিত করছে।
সকল শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে, এগিয়ে যাক বাংলাদেশ ক্রিকেটের জয়রথ। ক্রিকেটের জন্য যে আমাদের অনেক ভালোবাসা।
প্রভাষ আমিন: সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।
probhash2000@gmail.com
পাঠক মন্তব্য
তিক্ত হলেও সত্য সাহসী উচ্চারণের জন্য ধন্যবাদ!!
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন