অতি-আনন্দে সংবাদে মুখের হাসির পরিবর্তে চোখ দিয়ে গড়িয়ে নামে জল। কেঁদে ফেলে মানুষ। লুইস সুয়ারেজের ক্ষেত্রে ঘটেছিল ঠিক এমনটাই। ২০১৪ বিশ্বকাপে জর্জো কিয়েলিনির কাঁধে সেই কামড়-কাণ্ডের পরও যখন তাকে দলে নেওয়ার কথা জানায় বার্সেলোনা, খুশির সেই সংবাদে কেঁদেই ফেলেন সুয়ারেজ। ক্লাব সতীর্থ জেরার্ড পিকেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উরুগুইয়ান ফরোয়ার্ড নিজেই বললেন, সেই কামড়-কাণ্ডের পরও বার্সা তাকে দলে নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় খুশিতে অঝোরে কেঁদেছিলেন তিনি।
২০১৪ বিশ্বকাপে সুয়ারেজের সেই কামড়-কাণ্ডের কথা সবারই মনে থাকার কথা। গ্রুপপর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয় সুয়ারেজের উরুগুয়ে ও ৪ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি। সমীকরণটা এমন ছিল, ম্যাচে যারাই জিতবে, তারাই উঠে যাবে শেষ ষোলতে। হারলেই ফিরতে হবে বাড়ি। মহাগুরুত্বপূর্ণ সেই ম্যাচেই ইতালিয়ান ডিফেন্ডার জর্জো কিয়েলিনির কাঁধে কামড় বসিয়ে দেন সুয়ারেজ।
হিংস্র, বিভৎস সেই ঘটনার পরও রেফারি তাকে কোনো কার্ড দেখানি বটে। তবে পুরো ফুটবল বিশ্বই দাঁড়িয়ে যায় সুয়ারেজের বিরুদ্ধে। বিশ্বজুড়ে পড়ে ছি ছি পড়ে যায়। সুয়ারেজ নিজেও বুঝতে পারেন বিপদ ঘনিয়ে আসছে। এমন জঘন্য কাণ্ডের পর বার্সেলোনার মতো সুখ্যাত ক্লাব সুয়ারেজের সঙ্গে চুক্তি করবে না বলেই ধারণা করেছিল সবাই। সুয়ারেজ নিজেও বুঝতে পারেন, তার স্বপ্নের বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার স্বপ্ন শেষ!
সেই ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল একদিন খেলবেন বার্সেলোনায়। কিন্তু কিছুতেই সেই স্বপ্ন ধরা দিচ্ছিল না। অবেশেষে ২০১৪ সালে সত্যি হয়ে ধরা দেয় তার সেই আজন্ম স্বপ্ন। ২০১৪ সালের ১১ জুলাই আনুষ্ঠানিক চুক্তির মাধ্যমে লিভারপুল ছেড়ে সুয়ারেজ পাড়ি জমান স্বপ্নের ঠিকানায়।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতেই সুয়ারেজকে কেনার আগ্রহ দেখায় বার্সেলোনা। স্বপ্নের ক্লাবের প্রস্তাব পেয়ে সুয়ারেজও একবাক্যে রাজি হয়ে যান। কিন্তু লিভারপুল তাকে কিছুতেই বিক্রি করতে রাজি ছিল না। তবে সুয়ারেজ যেহেতু রাজি, বার্সেলোনা তাই কথা-বার্তা চালিয়ে যেতে থাকে। কথা-বার্তা চূড়ান্ত হয়, গ্রীষ্মের দলবদল মৌসুম শুরু হলেই সেরে ফেলা হবে চুক্তি।
কিন্তু এই পাকা কথা পাকা করার আগেই সুয়ারেজ ঘটিয়ে বসেন ওই কামড়-কাণ্ড। যার শাস্তি হিসেবে ওই বিশ্বকাপ থেকে তো বটেই; সব ধরনের ফুটবল থেকেই তাকে ৪ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে ফিফা। নিষিদ্ধ, ঘৃণিত একজনকে বার্সা কিনবে, এমনটা ভাবাই যাচ্ছিল না।
কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে বার্সা ঠিকই সুয়ারেজকে দলে ভেড়ায়। নিষেধাজ্ঞার খড়্গ মাথায় নিয়ে বিশ্বকাপ আসর থেকে যেদিন বাড়ির পথ ধরেন সুয়ারেজ, তার ঠিক আগের দিনই বার্সেলোনার সভাপতি ও ক্রীড়া পরিচালক জুবিজারেতা জানিয়ে দেন, তার সঙ্গে ঠিকই চুক্তি করতে আগ্রহী তারা।
চার দিকে থেকে বানের জলের মতো ভেসে আসছিল নিন্দ, ভৎর্সনা, সমালোচনার তীর। কঠিন সেই মুহূর্তে বার্সা কর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদে সুয়ারেজ এতো বেশি খুশি হন যে, চোখের জল ঠেকাতে পারেননি। প্লেয়ার্স টিবিউনের বিশেষ এক প্রোগ্রামে পিকেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুয়ারেজ নিজেই বলেছেন, ‘বিশ্বকাপ থেকে আমাকে বের করে দেওয়ার পর ভেবে ছিলাম সব শেষ। তবে তারপরই জুবিজারেতা ও বার্সা সভাপতির সঙ্গে কথা হয় আমার। তারা আমাকে শান্ত থাকতে বলেন। এবং জানিয়ে দেয়, এখনো তারা আমাকে দলে নিতে চায়। এটা বলতে কোনো দ্বিধা নেই আমার, তাদের কথা শোনার পর কেঁদে ফেলেছিলাম আমি।’
একটু থেমে আবার বলেছেন, ‘ওই ঘটনা মেনে নেওয়া এবং আমার প্রতি তাদের আস্থা রাখাটা ছিল আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। কারণ, ওই মুহূর্তটা ছিল আমার জন্য অনেক কঠিন। বার্সেলোনার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ।’
ওই কামড়-কাণ্ড সুয়ারেজকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে ফেলে মাঠেই। ঘটনার পর সুয়ারেজ কতটা ভেঙ্গে পড়েছিলেন সেটা একটা তথ্যেই স্পষ্ট। ম্যাচের শেষ দিকে অধিনায়ক দিয়েগো গডিনের একমাত্র গোলে জয় পায় উরুগুয়ে। দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করা গোলের পর স্বাভাবিকভাবেই উরুগুয়ের খেলোয়াড়েরা মেতে উঠেন বাধভাঙ্গা আনন্দে। কিন্তু গোলদাতা গডিনকে কেন্দ্র করে বাকি সবাই বাধভাঙ্গা উদযাপন করলেও সুয়ারেজ সেই উদযাপনের সঙ্গী ছিলেন না। গোল উদযাপনের শক্তি-বাসনা হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন