তখনো শ্রীলঙ্কা দলের কোচের দায়িত্ব নেননি চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। দায়িত্ব ছেড়েছেন বাংলাদেশের। দেশের কোচ হওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন। এমন সময় শ্রীলঙ্কার সংবাদপত্র ডেইলি মিররের ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক ইতিহাস পর্যালোচনা করে একটি বিশাল লেখা লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, ডেভ হোয়াটমোর, টম মুডির, ট্রেভর বেইলিস কিংবা গ্রাহাম ফোর্ডের মতো সাবেক লঙ্কান কোচদের মতো সাফল্য রাতারাতি হাথুরুসিংহের পক্ষে পাওয়া সম্ভব না। আর বাংলাদেশ দলের দারুণ সাফল্য এবং বিশ্ব ক্রিকেটে সমীহ জাগানো শক্তি হিসেবে উঠে আসার পেছনেও তিনি হাথুরুর চেয়ে টাইগার ক্রিকেটারদের সাফল্যের কথাই তুলে ধরেছিলেন বেশি করে। ছিল আরো বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের কাছে ত্রিদেশীয় সিরিজে রেকর্ড ১৬৩ রানের ব্যবধানে শুক্রবার হারল শ্রীলঙ্কা। তার আগে হেরেছে জিম্বাবুয়ের কাছে। তাদের ফাইনালে খেলাই শঙ্কায়। তো ২০ জানুয়ারি কয়েক সপ্তাহ আগের সেই লেখাটা আবার প্রকাশ করেছে মিরর। দুর্দান্ত লেখাটি পরিবর্তন ডট কমের পাঠকদের জন্য নিজের ভাষায় অনুবাদ করেছেন ইম্মানুয়েল শোভন মন্ডল।
রূপকথাতেই ব্যাঙকে চুমু দিয়ে রাজকুমার বানানো সম্ভব। বাস্তবে যে তা অসম্ভব, সবাই জানেন। তবুও মানুষ এমন কিছুর আশাতেই বসে থাকে। গেল বছর খুবই বাজে পারফর্ম করেছে শ্রীলঙ্কা। তাই তারা অনেক আশা করে চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে জাতীয় দলের কোচ বানিয়েছে। যেন রূপকথার মতই হুট করে সব পরিবর্তন করে ফেলবেন তিনি। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে অনেক সাফল্য পেয়েছেন হাথুরুসিংহে। দলটি ধারাবাহিকভাবে ম্যাচ জিততে শিখেছে। ২০০০ সালে টেস্ট অভিষেকের পর এটারই অভাব ছিল দলটির। শ্রীলঙ্কার সাবেক ওপেনার হাথুরুসিংহে কি এবার লঙ্কানদের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে দিতে পারবেন। আর বাংলাদেশের সাফল্যের কৃতিত্ব কি শুধু তারই?
শ্রীলঙ্কা আসলে বিশ্ব ক্রিকেটের এক উদাহরণ। ১৯৯৬ সালে তাদের এমন একটি দল বিশ্বকাপ জিতেছিল যাদের নিয়ে আশা করেনি খোদ লঙ্কানরাই। সেই দলটিকে জেতানোর কৃতিত্ব কি তখনকার কোচ ডেভ হোয়াটমোরের একার? ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে কোচ টম মুডি দলকে উঠিয়েছিলেন নাকি লঙ্কান খেলোয়াড়রা? ট্রেভর বেইলিস কোচ হয়ে না আসলে কি ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা কোন সাফল্য পেত না? গ্রাহাম ফোর্ডকে কোচ হিসেবে না পেলে কি শ্রীলঙ্কা ২০১২ সালে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলত না? ২০১৪ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের আগের তিন মাসে কোচ পল ফারব্রেসের পড়ে দেয়া মন্ত্রেই কি শিরোপা জিতেছিল লঙ্কানরা?
'৯৬ এর বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা দলের অধিনায়ক ছিলেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা। লঙ্কানদের সর্বকালের সেরা দলনেতা মানা হয় তাকে। রানাতুঙ্গাকে ঘিরে ছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা, রোশান মাহানামা, হাশান তিলকরত্নে ও আসানকা গুরুসিনহার মত ক্রিকেটাররা। তাদের বাইরে দলে আরো ছিলেন সনাথ জয়সুরিয়া, মুত্তিয়া মুরালিধরন ও চামিন্দা ভাসের মত তরুণ পারফর্মার। অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের দারুণ মিশেলে সেবার বিশ্বজয় করে শ্রীলঙ্কা। এই খেলোয়াড়দের ছাড়া আলাদিনের চেরাগ ব্যবহার করেও জেতা সম্ভব ছিল না হোয়াটমোরের পক্ষে।
২০০৫ সালে টম মুডি শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নেয়ার পর ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে লঙ্কানরা। '৯৬ এর সেই তরুণ জয়সুরিয়া, মুরালিধরন, ভাস, মারভান আতাপাত্তুরা তখন তাদের ফর্মের শীর্ষে। জয়ের পথ মুডিই তাদের দেখিয়েছিলেন। কিন্তু পথটা তো পাড়ি দিতে হয়েছে সেই ক্রিকেটারদের।
২০০৭ এর বিশ্বকাপের পর থেকে নিয়মিত পারফর্ম করে দলকে জয় এনে দেন কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনে, তিলকরত্নে দিলশান, মুরালিধরন, রঙ্গনা হেরাথ, লাসিথ মালিঙ্গারা। ভাস, জয়াসুরিয়া, আতাপাত্তুদের অবসরের পর দলের দায়িত্ব নেন এই ক্রিকেটাররাই। কোন বৈশ্বিক শিরোপা না জিতলেও ২০০৯ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ও ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট দল ছিল শ্রীলঙ্কা।
২০১২ সালে বেইলিসের কাছে থেকে শ্রীলঙ্কার কোচের দায়িত্ব যায় গ্রাহাম ফোর্ডের কাছে। সেবছরই টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে দলটি। মুরালিধরন ছাড়া আগের পারফর্মাররা তখনো বহাল তবিয়তে খেলছেন। সেই একই খেলোয়াড়রা ফারব্রেসের অধীনে ২০১৪ সালে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জেতেন।
এরপর থেকেই ধীরে ধীরে অবনমন শুরু হয় শ্রীলঙ্কার। জয়াবর্ধনে, সাঙ্গাকারা, দিলশানরা অবসর নেয়ার পর ম্যাচ জেতানোর মত খেলোয়াড়দের যে যোগানটা এতদিন পেয়ে এসেছে লঙ্কানরা তা হারিয়ে যায়।
এরপর ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ফোর্ড আবার দায়িত্ব নেন শ্রীলঙ্কা দলের। তার আগে মারভান আতাপাত্তুর নেতৃত্বে ইংল্যান্ডে মাত্র একটা টেস্ট সিরিজ জিতেছিল লঙ্কানরা। আর ফোর্ডের দ্বিতীয় দফা কোচিংয়ের সময় শ্রীলঙ্কা অস্ট্রেলিয়াকে ঘরের মাটিতে ৩-০ ব্যবধানে হারায়। কিন্তু পরবর্তীতে বেশ কিছু হারের কারণে ৪৫ মাসের চুক্তির ১৬ মাস পূর্ণ হতেই চাকরি ছাড়তে হয় ফোর্ডকে। তিন বছরের ব্যবধানে জয়াবর্ধনে, সাঙ্গাকারা, দিলশান অবসর নেওয়ায় দলের দায়িত্ব নেয়ার মত আর খেলোয়াড় পায়নি শ্রীলঙ্কা।
ফোর্ড খুব ভালমত বিষয়টি বুঝতেন। তাই দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার সময় বলেছিলেন দলটিকে নিয়ে তড়াহুড়ো করার কিছু নেই, 'শ্রীলঙ্কা পুনর্গঠনের প্রথম পর্যায়ে আছে। হঠাৎ করেই কোন পরিবর্তন আসবে না।'
বর্তমানে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ, হেরাথ ও মালিঙ্গারা দলটির মূল খেলোয়াড় হলেও তার নিজেরাই আদর্শ অবস্থায় নেই। মাঝে মাঝে ভাল পারফরম্যান্স দেখা গেছে দলটির। কিন্তু আগের সেই ধারাবাহিকতাটি হারিয়ে ফেলেছে তারা- ম্যাচের ফলাফল ও খেলোয়াড়দের উঠে আসা সবক্ষেত্রেই।
কোচ হিসেবে হাথুরুসিংহেকে বাংলাদেশিরা অনেক পছন্দ করেন। কারণ টাইগারদের অনেক বড় বড় সাফল্য এসেছে তার হাত ধরে। তবে শ্রীলঙ্কা দলে হোয়াটমোর, মুডি, ফোর্ড, ফারব্রেসরা যেমন প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের একটি গ্রুপ পেয়েছিলেন; তেমনভাবে হাথুরুসিংহেও সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহীম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মত একদল অভিজ্ঞ ও প্রতিভাবান কোর খেলোয়াড় পেয়েছিলেন। কোচ হিসেবে তিনি শুধু দলের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে দিয়েছেন। মাঠ থেকে জয় তুলে এনেছেন খেলোয়াড়রা। এর ফল হাতেনাতেই পেয়েছেন এই সাবেক লঙ্কান ক্রিকেটার। বাংলাদেশের সাফল্যের বদৌলতেই তিনি এখন ক্রিকেট বিশ্বে একজন হাই-প্রোফাইল কোচ হিসেবে বিবেচিত হন।
শ্রীলঙ্কা দলে হাথুরুর করণীয় হলো যতো দ্রুত সম্ভব দলের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। এরপর তারা জিততে শুরু করলে হাথুরুসিংহে হবেন হিরো।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি শ্রীলঙ্কা দলের দায়িত্ব নেওয়ার সময় হোয়াটমোর, মুডি, বেইলিস কিংবা ফোর্ডের প্রথমবার দায়িত্বপালনের সময়কার মতো বিলাসিতা করার সুযোগ পাবেন না। ৪৯ বয়সী মানুষটির জন্য সত্যিকারের 'পরীক্ষা'ই এখন অপেক্ষায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন