রাশিয়া বিশ্বকাপের পর্দা উঠবে আগামী ১৪ জুন। এবারের আসরে সাতটি মুসলিম দেশ অংশ নিচ্ছে। তারা হলো মিসর, সৌদি আরব, ইরান, মরক্কো, নাইজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও সেনেগাল। তবে ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপের প্রথম আসরে কোনো মুসলিম দেশ প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি। পরে ১৯৩৪ সাল থেকে নিয়মিতভাবে এ আসরে মুসলিম দেশগুলো অংশগ্রহণ করে আসছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ পর্যন্ত শুধুমাত্র একবার সেমিফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ছাড়া মুসলিম দেশগুলো আর কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি।
ইউরোপ আমেরিকার অমুসলিম দেশগুলো অপ্রতিরোধ্য প্রাধান্যের বিপরীতে ২০০২ সালে প্রথমবারের মতো সৌদি আরব, তুরস্ক, স্পেন, সেনেগাল ও তিউনিসিয়া এই পাঁচটি দেশ একসাথে বিশ্বকাপে খেলার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করে। এই বছর প্রথমবারের মতো তুরস্ক মুসলিম দেশ হিসেবে সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে এবং স্বাগতিক দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে তৃতীয় স্থান পায়।
এর আগে ১৯৫৪ সালে বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়া ও হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারলেও জার্মানির কাছে হেরে গিয়ে পয়েন্ট টেবিলে জার্মানির সাথে যুগ্মভাবে শীর্ষে থাকলেও প্লে-অফ ম্যাচে হেরে গিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শেষ হয়ে যায় মুসলিম প্রতিনিধিত্বকারী দেশটির। অবশ্য সেবার প্রতি গ্রুপ থেকে একটি করে দলের দ্বিতীয় পর্যায়ে উঠার সুযোগ থাকায় সমূহ একটা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। প্লে-অফ ম্যাচে তারা (২-৭) গোলের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়।
এরপর সুদীর্ঘ ৪৮ বছর অপেক্ষা করতে হয় মুসলিম দেশগুলোকে। ২০০২ সালের বিশ্বকাপে পুনরায় সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে মুসলিম দেশগুলোর প্রাণে নতুন আশার সঞ্চার করে। প্রথম ম্যাচে সেনেগাল ডিফেডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে আরেকটি চমক দেখিয়েছিল।
১৯৩৪ বিশ্বকাপে প্রথম পর্ব থেকেই চালু হয় নকআউট পদ্ধতির। এ আসরে মুসলিম দেশ মিসর হাঙ্গেরির কাছে পরাজিত হলেও চমক সৃষ্টি করে স্পেন। স্পেন ব্রাজিলকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা পায়। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে নির্ধারিত সময় ইতালির সাথে ড্র হলে রিপ্লে ম্যাচ খেলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। রিপ্লে ম্যাচে ইতালির কাছে (০-১) গোলে হেরে যায় স্পেন। ফলে থেমে যায় তাদের অগ্রযাত্রা। তবে ৫৮,৬২ ও ৬৬ সালে বিশ্ব আসরে স্পেনই মুসলিম দেশগুলোর একক নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করে।
১৯৫৪ সালে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তুরস্ক চমক সৃষ্টি করে। মরক্কো ৭০ সালের বিশ্বকাপে অভিষিক্ত হয়। ৮২ সালে আলজেরিয়া অভিষেক ম্যাচে পশ্চিম জার্মানিকে ২-১ গোলে, চিলিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে চমকে দেয় বিশ্বকে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে চমক লাগিয়ে দেয় আফ্রিকার এ দেশটি। ইংল্যান্ড, পোল্যান্ডের মতো দলকে ধরা খাইয়ে দেয় তার। দুই দলের বিপক্ষেই গোলশূন্য ড্র করে মরক্কো। এখানেই শেষ নয় পর্তুগালকে ৩-২ গোলে উড়িয়ে দেয় তারা। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ‘এফ’ গ্রুপ থেকে নেদারল্যান্ডকে ২-১ গোলে পরাজিত করে মরক্কো। ১৯৯৮’র ফ্রান্স বিশ্বকাপে খেলে দলটি। সে বছর গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচে একটি জয়, একটি হার আর একটি ড্র নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় মরক্কোকে। এরপর টানা চার বিশ্বকাপে সুযোগ পায়নি তারা। দুই দশক পর আবারো বিশ্বকাপে পা রাখতে যাচ্ছে মরক্কো।
বিশ্বকাপে ইরানের অভিষেক হয় ১৯৭৮ সালে। তবে শুরুটা ভালো হয়নি তাদের। গ্রুপ পর্বের একটি ম্যাচেও ভালো করতে পারেনি তারা। এ পর্যন্ত মোট পাঁচবার বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে ইরান। ১৯৭৮, ১৯৯৮, ২০০৬, ২০১৪ এবং সর্বশেষ ২০১৮। তবে একমাত্র ১৯৯৮ বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডের প্রথম ম্যাচেই যুগোস্লাভিয়াকে হারিয়েছিল তারা। এরপর আরে কোনো আসরে জয়ের মুখ দেখতে পারেনি।
১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে প্রথম অভিষেক হয় সৌদি আরবের। প্রথমবারই চমক দেখায় তারা। গ্রুপ পর্বে নেদারল্যান্ডস ও মরক্কোকে হারিয়ে নকআউট পর্বে নাম লেখায় সৌদি আরব। পরে সুইডেনের কাছে হেরে বিদায় নেয় আসর থেকে। বিশ্বকাপে ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি। টানা তিনটি (১৯৯৮, ২০০২ ও ২০০৬) বিশ্বকাপ আসরে অংশ নিতে পারেনি তারা। খেলতে পারেনি ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ২০১৪ সালে ব্রাজিলের মাটিতিও। অবশেষে দীর্ঘ এক যুগ পর জাপানকে ১-০ হারিয়ে বিশ্বকাপের টিকিট পায় সৌদি আরব।
১৯৭৮ সালে তিউনিসিয়া এবং ৯০' সালে আরব আমিরাত বিশ্বকাপে খেলতে আসলেও আশানুরূপ পারফরমেন্স প্রদর্শন করতে পারেনি। কলম্বিয়া, জার্মানি ও যুগোশ্লাভিয়ার সাথে পরাজিত হয়ে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিতে হয় আরব আমিরাতকে।
১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপে খেলতে আসে ইরাক। সেবার মরক্কোও দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে। অবশ্য বাছাই পর্বে ইরাকের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখা যায় মূল পর্বে তার ছিটেফোঁটাও চোখে পড়েনি। প্যারাগুয়ে, মরক্কো এবং বেলজিয়ামের সাথে হেরে গিয়ে কোনো পয়েন্ট সংগ্রহ ছাড়াই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয় তাদের।
১৯৯৪ বিশ্বকাপে প্রথম সুযোগ পেয়েই সবাইকে চমকে দিয়ে নকআউট পর্বে পৌঁছে যায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ নাইজেরিয়া। পরেরবারও নকআউট পর্ব থেকে বাদ পড়ে। তবে প্রথম ম্যাচেই স্পেনকে হারায় তারা। আর দ্বিতীয় ম্যাচে বুলগেরিয়াকে। তবে শেষ ম্যাচে প্যারাগুয়ের সাথে আর জিততে পারেনি। নকআউট পর্বে ডেনমার্কের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ে তারা। এরপর ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপেও গ্রুপ পর্ব পার করেই বিদায় নেয় তারা।
বিশ্বকাপের প্রতিটি আসরে কয়েকটি মুসলিম দেশ অন্তর্ভুক্ত হলেও সেরা আসরে তারা তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারছে না। তবে এবার মোহাম্মদ সালাহ, সাদিও মান, ভিনসেন্ট এনইয়ামা, সর্দার আজমুন, তাইসির আল জাসিম ও মেহদি তারেমির মতো তারকা ফুটবলার আছে। তাদের নিয়ে বিশ্বকাপের সামনে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে মুসলিম দেশগুলো।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন