আমাদের হিসাব বলছে ঢাকায় আসার পর থেকে ক্রিকেট খেলা, অনুশীলন, বাসায় ও পুনর্বাসনের সময় সব মিলিয়ে ছোট-বড় ১২টি ইনজুরি শিকার হয়েছে মাশরাফি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল হাঁটুটা দফায় দফায় হাঁটু খুলে লিগামেন্টে এই অপারেশন করতে গিয়ে ভয়ংকর কিছু ক্ষতি স্থানীয়ভাবে হয়ে গেছে মাশরাফির । আসলে ক্ষতিটা শুধু আর হাঁটুতে সীমাবদ্ধ নেই।
মাশরাফির শরীরের কী অবস্থা, এটা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিসিবির প্রধান চিকিৎসক ডক্টর দেবাশিস চৌধুরী একটা ইংরেজি প্রবাদ উচ্চারণ করলেন- আ চেইন ইস অ্যাস স্ট্রং, অ্যাস ইটস উইকেস্ট লিংক; একটা চেন ততটাই শক্ত, যতটা তার দুর্বলতম সংযোগটা শক্ত।এখন এটা মোটামুটি দেশবাসীর জানা কথা যে, মাশরাফির শরীরের দুর্বলতর দুটি সংযোগ হলো হাঁটু। ফলে তার শরীরের বাকি সংযোগ গুলোও এই দীর্ঘ সময়ে ওই হাঁটুর মতোই বা তার কাছাকাছি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এটা কেন হয়, বোঝাতে গিয়ে ডা দেবাশিস আমাদের কিছু মৌলিক কথাও বললেন, "আসলে শরীরে এত বড় একটা আঘাত যখন থাকবে, তখন আপনার মস্তিষ্ক চেতনে বা অবচেতনে ওই আঘাতের জায়গায়টাকে নিরাপদ রাখতে চাইবে। ফলে সে কী করবে, শরীরের ভর ও চাপ ওই হাঁটু দুটো থেকে অন্য কোথাও সরিয়ে দিতে চাইবে ।মানে, আপনার ডান হাঁটু ব্যথা থাকলে, আপনি বাঁ পায়ে ভর দিয়ে সব করতে চাইবেন; বাঁ পাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এবার দুটো হাঁটু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর আপনি ভরটা গোড়ালিতে বেশি দিতে চাইবেন ; সে দুটোও যাবে। এরপর এমন সব জায়গায় ভর দেওয়ার চেষ্টা করবেন, যেখানে ভর দেওয়ার কথাই নয়। মাশরাফির ক্ষেত্রে গত কয়েক বছর সেটা হচ্ছে। সে হাঁটু ও গোড়ালির ভর শরীরের বিচিত্র সব জায়গায় ছড়িয়ে দেয় খেলার সময়। সেসব জায়গায় কোনো চাপ নিতে তৈরি ছিলো না। ফলে শরীরের বাকি সংযোগ গুলোও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত এখন। সোজা কথায়, তার পুরো শরীর এখন হাঁটুর মতো হয়ে গেছে।"
ডক্টর দেবাশিসের এই কথায় বুঝিয়ে দিতে পারে, আসলে মাশরাফির শরীরটা কয়েক বছর ধরে ঠিক কী অবস্থায় মাঠে ছোটাছুটি করছে। শুধু হাঁটুর প্রসঙ্গে যদি আসি, তাহলে দেখতে পাবো, দুই হাঁটুতে সাতটি অপারেশন। সবগুলো অপারেশনের চরিত্র যে ঠিক একই রকম, তা নয় । কোনোটাতে নতুন করে লিগামেন্ট বসাতে হয়েছে, কোনোটাতে হাঁটু খুলে লিগামেন্টে চেপে দিতে হয়েছে। কিন্তু মৌলিক সমস্যা দুই হাঁটুতে একই-এন্টিরিয়ার ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট (ACL) ছেড়া ও পুর্ণগঠিত।এই লিগামেন্ট বলা যায়, একেবারে হাঁটুর কেন্দ্রে থাকা দড়ি, যা পায়ের ওপর ও নিচের হাড়কে বেঁধে রাখে । এর পাশে আরও কয়েকটি লিগামেন্ট আছে । তবে এই মূল লিগামেন্টটিই আসলে প্রধান দড়ির কাজ করে। আর মাশরাফির ক্ষেত্রে দুই পায়েই এই লিগামেন্ট ছেঁড়া, পরে জোড়া দেওয়া।
এতে সমস্যা কি?
আমরা আবারও দেবাশিস চৌধুরীর স্মরণে নেই। তিনি মাশরাফির প্রতিটা ইনজুরি দেখেছেন, বিকেএসপিতে থাকা অবস্থা থেকে শুরু করে দেখেছেন এই পেসারকে। তিনি বলেছিলেন, "এসিএল একবার পুনর্গঠন করা (জোড়া দেওয়া) হলেও হাঁটুটা নড়বড়ে থেকে যাবেই। আর ওর তো তিনবারের বেশি করে জোড়া দেওয়া হয়েছে। এই নড়বড়ে ব্যাপারটা খুব সামান্য, কয়েক মিলিমিটার মাত্র । কিন্তু মানুষের শরীরের জন্য এই কয়েক মিলিমিটার মহা ব্যাপার। এই নড়তে থাকার ফলে মানুষের পুরো চলাফেরা অনিশ্চিত হয়ে যায়, মানে সে এক অনিশ্চিতার অনুভূতি নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে। সে জানে না, পরের ধাপটায় সে সঠিক জায়গায় পা ফেলতে পারবে কিনা.! কারণ হাঁটু সামান্য দুলে যেতে পারে। এক প্রবল নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার অনুভূতি নিয়ে তাকে চলাফেরা করতে হয় ।"
এই অনুভূতির পাশাপাশি এসিএল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পুরো হাঁটুটাই কার্যত আস্তে আস্তে ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে। এসিএলের জন্য নড়তে থাকা হাঁটুর কল্যাণে হাঁটু সামান্যতেই মোড় খেয়ে যায়, ঘুরে যায়। তখন বাইরের দিকে থাকা লিগামেন্ট গুলো ছেড়ে বা আঘাত পায়। এর পাশাপাশি বারবার এই অস্ত্রপাচারে হাঁটুর নিচের দিকে অংশের ওপরে থাকা মিনিসক্লাস নামে নরম অংশটি কমে আসতে থাকে, যা হাঁটুর ঘর্ষণে হাড়ের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। এর ফলে শুরু হয় সরাসরি হাড়ের ক্ষয়; সেটা মাশরাফির শুরু হয়ে গেছে ।
সূত্র- মাশরাফি (বই)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন