চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পরিচ্ছন্ন খাতে ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো। এছাড়া বহদ্দারহাট হতে বাড়ৈ পাড়া পর্যন্ত খাল খননে ১৪২ কোটি টাকা, জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য যান ও যন্ত্রপাতি ক্রয় বাবদ ২৫ কোটি টাকা, সেতু কালভার্ট নির্মাণে ১০ কোটি টাকা, হিজড়া খাল খননে ৫০ লাখ টাকা, ফুটপাত উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণে ১২৫ কোটি টাকা, জাইকার প্রস্তাবিত প্রকল্পে ১১৫ কোটি টাকা এবং বিবিধ খাতে ১৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছিলো। তখন বলা হয়েছিলো পরিচ্ছন্ন বিভাগকে আরো সক্রিয় করা হচ্ছে। শহর পরিচ্ছন্ন হলে এবং নগরীর পুরানো খালসমূহ পুনরুদ্ধার করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো গেলে জলাবদ্ধতা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। কিন্তু সেসব প্রতিশ্রুতর বয়ান বাস্তবে সুফলতা বয়ে আনতে পায়নি। শুক্রবারের কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতে বরাবরের মতোই কোমর পানিতে ডুবে গেছে চট্টগ্রাম।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন আরো বলেছিলেন, সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টার মধ্যে ময়লা আবর্জনা নিকটস্থ ডাস্টবিন, কন্টেইনারে ফেলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটলে বা যত্রতত্র, নালা-নর্দমা, বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনায় ময়লা আবর্জনা ফেলা হলে অথবা খাল, নালা দখল করে রাখা হলে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আইনের বিধি বিধান অনুযায়ী অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাজেট অধিবেশন বক্তৃতায় তিনি আরো বলেছিলেন, জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা হলেও তা সমাধান করা কঠিন নয়। জোয়ারের পানি ও অবিরাম বর্ষণজনিত জলাবদ্ধতা প্রাকৃতিক হলেও পরিকল্পিত উদ্যোগ এর মাধ্যমে তা নিরসন করা সম্ভব। তিনি বলেছিলেন, মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী নতুন খাল খননের পাশাপাশি বিলুপ্ত খালগুলোর নাব্যতা উদ্ধার, নালা নর্দমাগুলোর সংস্কার ও পরিসর এবং গভীরতা বৃদ্ধি, মানবসৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসন, প্রবল বৃষ্টি ও অতি জোয়ারের পানি নিয়ন্ত্রণে খালের মুখে পাম্প হাউজসহ স্লুইস গেট নির্মাণ করা হবে।
এ লক্ষ্যে চসিকের সাথে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিডিএ, রেলওয়ে, পরিবেশ অধিদপ্তর, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লি., বাংলাদেশ টেলি কমিউনিকেশন লিমিটেড, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, নেভাল র্কর্তৃপক্ষ, গণ-পূর্ত অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, চট্টগ্রাম ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়ে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেছিলেন, ইতোপূর্বে প্রনীত ১৯৯৫ সনের ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে নতুন আঙ্গিকে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি পরিচালনাপূর্বক বিশেষজ্ঞ দ্বারা নতুন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হবে। তাছাড়া চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরীকে সুয়ারেজ সিস্টেমে আনার লক্ষ্যে নতুন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। কিন্তু সেসব প্রতিশ্রুতির কোনটাই আলোর মুখ দেখেনি। নগর জুড়ে যত্রতত্র আবর্জনার ভাগাড়। আর সেসব আবর্জনা নালায় আটকে গিয়ে বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।
জানা যায়, চট্টগ্রামকে পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৯৫ সালে তৈরি হয়েছিল একটি মাস্টারপ্ল্যান। তবে বরাদ্দ সংকটে বাস্তবায়নের আগেই শেষ হয়ে গেছে এ ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের মেয়াদ। ।গত এক যুগে তিন মেয়র খরচ করেছেন প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। অপরিকল্পিতভাবে এ টাকা খরচ হওয়ায় জলে গেছে জলাবদ্ধতা নিরসনের সব টাকাই।
জলাবদ্ধতা নিরসনে সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী তার সর্বশেষ মেয়াদে ২০০৩-০৪ থেকে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৬৬ কোটি ১১ লাখ টাকা, মনজুর আলম ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত ২০৫ কোটি ৫২ লাখ ও বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ২০১৫-১৬ অর্থবছরে খরচ করেছেন ২১ কোটি টাকা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী জেরিনা হোসেন বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ না হওয়ার খেসারত দিচ্ছে চট্টগ্রামবাসী। একেক সংস্থা একেক রকমভাবে সরকারি বরাদ্দ খরচ করায় জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল কাজটি হয়নি পরিকল্পনামতো। তিনি আরো বলেন, শুধু মাস্টারপ্ল্যান নয়, পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানও।]
২০০৭ সালে সিডিএ, সিটি করপোরেশন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং ওয়াসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান তৈরি করার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে হাজার কোটি টাকা খরচ ধরে তৈরি করা সেই প্রস্তাবনা চূড়ান্ত হয়নি এখনও। জলাবদ্ধতা নিরসনে এ প্ল্যানের খসড়ায় ছিল ২২টি প্রাকৃতিক খাল পুনরুদ্ধার ও ৩৩টি নতুন খাল খননের প্রস্তাব। জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৯৯৫ সালে প্রণীত মাস্টারপ্ল্যানে অগ্রাধিকার ছকে ছিল ১০টি ড্রেনেজ এলাকায় পাঁচ পর্যায়ে ড্রেনেজ কার্যক্রম বাস্তবায়নের সুপারিশ। নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে এতে ষোলশহর থেকে বহদ্দারহাট, বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী, শীতল খাল থেকে নয়া খাল পর্যন্ত তিনটি নতুন খাল খনন এবং ৩০টি নতুন সেকেন্ডারি খাল খননের সুপারিশ ছিল।
আরো জানা গেছে, মহিউদ্দিন চৌধুরী তার সর্বশেষ মেয়াদকালে চাক্তাই খালের দুই পাশে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ এবং খালের তলা পাকা করার প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় করেছেন ২৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। বহদ্দারহাটের খাজা সড়কের নালার উন্নয়নে খরচ করেছেন তিন কোটি টাকা। এ ছাড়া নালা-নর্দমা ও খাল থেকে মাটি উত্তোলন, নালা-নর্দমা ও প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণে ব্যয় করেছেন ৩৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ২০০৮-০৯ সালে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য তিনি দুই কোটি ৪২ লাখ টাকায় সাতটি খননযন্ত্র কেনেন। এভাবে শেষ পাঁচ বছরে তিনি মোট ৬৬ কোটি ১১ লাখ টাকা খরচ করেছেন। মেয়র মনজুর আলম তার পাঁচ বছরে ব্যয় করেছেন ২০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২২০০ ফুট দীর্ঘ ও ১৪ ফুট প্রশস্ত নালা নির্মাণ, মহেশখালের দুই পাড়ে ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যেও প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ, ৪৪টি ডাম্প ট্রাক, সাতটি খননযন্ত্র ও দুটি উভচর খনন যন্ত্র কেনা ও নালা-নর্দমা থেকে মাটি উত্তোলনে তিনি এ অর্থ ব্যয় করেন।
এদিকে শুক্রবার সকাল থেকে থেমে থেমে ভারী বুষ্টিপাত ভারী বৃষ্টিপাত ও কর্ণফুলীর ভরা জোয়ারের কারণে নগরীর নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতায় নগরবাসীর অসুবিধা হওয়ায় ‘আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ’ করেছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।
শুক্রবার দুপুর সোয়া ১২টায় সরেজমিন আগ্রাবাদ সিমেন্ট ক্রসিং ও ১৫ নম্বর ঘাট এলাকা পরিদর্শন করেছেন বলে জানা গেছে।
মুঠোফোনে মেয়রের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগকে দিন-রাত কাজ করে ময়লা-আবর্জনা নালার মুখ থেকে অপসারন করতে বলেছি। তারা নালার মুখ পরিস্কার রাখতে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা তার উত্তাধিকার সূত্রে পাওয়া। যার ত্যৎক্ষনিক সমাধান সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন