রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পের ১৭ নম্বর সেক্টরের ৩০৩ নম্বর সড়কের ৮ নম্বর প্লটে একটি ভবনের তিনতলা পর্যন্ত উঠেছে। নকশা অনুমোদন ছাড়াই পুরোদমে কাজ চলছে জানতে পেরে তদারককারীদের কাছ থেকে মালিকের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করা হয়। পাঁচ কাঠা প্লটটির মালিক রিপন মিয়া জানান, ছয়তলা হবে। রাজউকের প্রকল্প বলে এবং পূর্বাচলের প্রকল্প পরিচালক, অথরাইজড অফিসার প্রমুখের সঙ্গে তার ভালো পরিচয় আছে বলে নকশা পাসে সমস্যা হবে না। তাই কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
শুধু রিপন মিয়ার বাড়ি নয়, গত সোমবার সরেজমিনে দেখা গেল, প্রকল্প এলাকায় শতাধিক ভবন এরই মধ্যে উঠে গেছে, যেগুলোর একটিরও রাজউকের নকশা অনুমোদন নেওয়া হয়নি। নির্মাণকাজ চলছে প্রায় দুইশ' প্লটে। ভবন মালিকরা নকশা অনুমোদনের প্রয়োজনই বোধ করছেন না।
গত চার দশকে ঢাকার দ্রুতগতির উন্নয়নে এখন সরকারি, বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক মহলে প্রায়ই আলোচিত হয় পরিকল্পনাহীনতার কথা।
এলোমেলো যথেচ্ছ নির্মাণে নগরে বসবাসের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। অতিসম্প্রতি ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী প্রভৃতি আবাসিক এলাকার মধ্য থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরানোর আদেশ দিয়ে উচ্ছেদ অভিযানে এক জটিল অবস্থার উদ্ভব হয়। আগের নিয়ন্ত্রণহীনতার জগাখিচুড়ি এখনও অব্যাহত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় পূর্বাচলের নির্মাণকাজে। সেখানে আবাসিকের পাশাপাশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ডেইরি ফার্ম, এমনকি গোডাউনের জন্যও ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে নকশা অনুমোদনহীন নতুন ভবনগুলো। অভিযোগ পাওয়া গেছে, রাজউকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এসব ভবন মালিকের কাছ থেকে কিছু সুবিধা নিয়ে না দেখার ভান করছেন। ফলে পূর্বাচলে পরিকল্পিত ও উন্নত মানের উপশহর তৈরির যে পরিকল্পনা সরকার নিয়েছিল, তা ভেস্তে যেতে বসেছে। স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, এ রকম হলে স্বপ্নের দৃষ্টিনন্দন আবাসিক এলাকা আর হবে না, মিশ্র এলাকায় পরিণত হবে পূর্বাচল।
এ প্রসঙ্গে রাজউকের চেয়ারম্যান বজলুল করিম চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এ প্রতিবেদকের কাছ থেকে কোন কোন সেক্টরে ভবনগুলো গড়ে উঠেছে সে সম্পর্কে অবহিত হন। পরে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত বা আদি বাসিন্দা যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাদের কেউ যদি অস্থায়ী ভিত্তিতে থাকার জন্য টিনশেড বা অস্থায়ী অবকাঠামো করে থাকেন সে ক্ষেত্রে তারা হয়তো কিছুটা নমনীয় থাকতে পারবেন; কিন্তু কেউ একতলার বেশি ভবন নির্মাণ করলে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি জানান, শিগগিরই তিনি এগুলো দেখার জন্য লোক পাঠাবেন।
উল্লেখ্য, আগে নিয়ন্ত্রণ না করে পরে নোটিশ দিয়ে ভাঙাভাঙির খেলা নগরবাসী অনেকবার দেখেছেন।
রাজউকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ পর্যন্ত পূর্বাচলের কেবল নারায়ণগঞ্জ অংশে কয়েকটি সেক্টরে নকশার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। রাস্তা, বিদ্যুৎ ও ড্রেনেজের মতো সব নাগরিক সেবা-সুবিধার কাজ শেষ না হলেও বাড়ি তৈরি হচ্ছে। অনেকে পল্লী বিদ্যুতের পুরনো সংযোগ নিয়ে চালাচ্ছেন।
জানতে চাইলে পূর্বাচল প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক উজ্জ্বল মলি্লক বলেন, তার জানা মতে, অনুমোদিত নকশার চেয়ে ঘরবাড়ি উঠেছে অনেক বেশি। সেটা দেখার দায়িত্ব ওই এলাকার অথরাইজড অফিসারের। তিনিই ভালো বলতে পারবেন।
পূর্বাচল প্রকল্প এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত অথরাইজড অফিসার মো. আদিলুজ্জামান সমকালকে বলেন, এ পর্যন্ত পূর্বাচলের নারায়ণগঞ্জ অংশে আটটি নকশার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বাড়ির কাজ শুরু করেছেন। বাকিরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
কিন্তু নকশা ছাড়াও অনেকে বাড়ি তৈরির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আদিলুজ্জামান বলেন, এ রকম ৩০ জন ভবন মালিককে তারা নোটিশ দিয়েছেন। কিন্তু শহর থেকে দূরে হওয়ায় সেখানে রাজউকের লোকজন যেতে চান না। তাদের জনবলেরও অভাব আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের এক কর্মকর্তা ও পূর্বাচলের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ তদারকির দায়িত্বে জাহিদ নামের একজন ইন্সপেক্টর আছেন। তিনি মাঝে মধ্যে যান বটে। যারা ভবন তৈরি করছেন তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ফিরে আসেন।
কথা বলার জন্য মহাখালীতে রাজউকের আঞ্চলিক অফিসে গিয়ে জাহিদকে পাওয়া যায়নি। ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
দেখা গেছে, কয়েকটি ভবনের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। পরিবার বসবাসও করছে। নকশা অনুমোদন না নেওয়ার বিষয়টি এসব বাড়ির মালিকরা স্বীকারও করছেন। সম্পূর্ণ হওয়া কিছু শূন্য ভবনের প্রধান ফটকে তালা দিয়ে রাখা। নিরাপত্তাকর্মী বা তত্ত্বাবধায়ক আছেন। তাদের কয়েকজন জানান, মালিকরা মাঝে মধ্যে বা ছুটির দিনে আসেন। কিছু সময় থেকে চলে যান। কেউ কেউ বন্ধু-বান্ধব নিয়ে রাত্রিযাপনও করেন।
স্থানীয়রা জানান, গত ৮ ও ৯ মে রাজউকের লোকজন পূর্বাচলের ৩০০ ফুট রাস্তার পাশে অভিযান চালিয়ে একটি বাজার ও কিছু টঙ দোকান উচ্ছেদ করে; কিন্তু অনুমোদনহীন ভবনগুলোর দিকে নজর দেয়নি।
১৩ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর সড়কে তৈরি তিনতলা ভবনের ফ্ল্যাটগুলোতে কয়েকটি পরিবার বাস করছে। ভেতরে আম-কাঁঠালের গাছও আছে। কাঁঠালও ধরেছে। প্রাচীরঘেরা বাড়ির মালিক কুদরতুল্লাহ রাজউক থেকে বাড়ির নকশা অনুমোদন না নিয়ে বাড়ি তৈরির কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আপাতত বাড়িটি অস্থায়ীভাবে তৈরি করেছেন। দশ বছরের মধ্যে পূর্বাচল সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যাবে। তখন এটা ভেঙে নকশার অনুমোদন নিয়ে বাড়ি বানিয়ে নেবেন। বিষয়টি রাজউকের লোকজনও জানে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে স্থানীয়দের অভিমত, ওই বাড়িটি নির্মাণে খরচ হয়েছে অন্তত এক কোটি টাকা। নিশ্চয় তিনি দশ বছর ব্যবহারের জন্য বাড়িটি বানাননি।
কুদরতুল্লার বাড়ির পাশেই আরেকটি চারতলা বাড়ির মালিক আলহাজ দীন মোহাম্মদ দিলুর ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে আল আমিন জানান, মামা আদি বাসিন্দা হিসেবে প্লটটি পেয়েছিলেন। তাদের যেখানে জমি ছিল। অধিগ্রহণের পরে তাদের ঘরবাড়ি ভাঙা পড়ে। তাদের তো থাকতে হবে, তাই বাড়ি বানিয়ে নিয়েছেন। ফোনে দীন মোহাম্মদ দিলু জানান, রাজউক তার প্লটের ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র দিয়েছে। রাজউকে নকশার জন্য আবেদনও তিনি করেছেন। রাজউক এই দেবো-দিচ্ছি করছে।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা ১ নম্বর সেক্টরে একটি তিনতলা ডুপ্লেক্স তৈরির কাজ শুরু করেছেন। অবকাঠামো উঠেছে। এটি নির্মাণের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এআরকে। সাইট ইঞ্জিনিয়ার মিলন জানান, 'স্যার লন্ডন-আমেরিকা থেকে একেকটি ডিজাইনের ছবি তুলে নিয়ে আসেন। সেভাবে করতে বলেন। ক'দিন আগে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের একটি ছবি দেখিয়ে সেটার মতো দরজা তৈরি করতে বলেছেন।'
নকশার অনুমোদন আছে কি-না জানতে চাইলে মিলন বলেন, 'নকশা নিয়ে তো আর অন্তত স্যারের সমস্যা হওয়ার কথা নয়।'
প্রতিমন্ত্রীর বাড়ির পাশেই ওই সেক্টরের ২০৩ নম্বর রোডে দেখা গেল একটি ভবন নাহি এমএস পাইপের গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গোডাউনের কর্মীরা জানান, এর মালিক ভোলার বাসিন্দা আবু নোমান হাওলাদার। বাড্ডায় তার অফিস। দেখা গেল, বিশাল গোডাউনের পাশে দুটি পাইপভর্তি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটি থেকে মাল খালাস করছেন শ্রমিকরা।
এর পাশেই আরেকটি তিনতলা ভবনের প্রতি তলায় চতুর্দিকে গ্রিল দেওয়া ব্যালকনিতে চেয়ার বসানো। দৃশ্যত আবাসিক চরিত্রের নয়। নানা রকম ভবন উঠেছে নকশা অনুমোদন ছাড়া। ভালো পরিবেশে যারা বসবাস করতে চান তেমন প্লটপ্রাপ্তদের অনেকের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলেন, এ রকম হতে থাকলে গতানুগতিক ঢাকার মতো জঞ্জালে পরিণত হবে পূর্বাচলও।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন