গুলিস্তান মোড়ে বাসে জানালার সামনে বসে দামি মোবাইলে কথা বলছিলেন রফিকুল ইসলাম। মুহূর্তে একজন দৌঁড়ে এসে টান দিয়ে তার মোবাইল নিয়ে গেলেন। রফিকুল হা-হুতাশ করেই থেমে গেলেন। কারণ, তিনিও জানেন ওই মোবাইল তার পক্ষে আর ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়। এমন দৃশ্য রাজধানীর চিহ্নিত কিছু জায়গায় নিয়মিত দেখা যায়। বিগত কয়েক দিনে রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা হঠাৎ বেড়ে গেছে।
এসব ঘটনায় মানুষ যে শুধু সর্বস্ব হারাচ্ছেন তা নয়, অনেকে গুরুতর আহত হচ্ছেন। প্রাণও হারানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি।
হঠাৎ ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার পেছনে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাকেই দায়ী করছে সাধারণ মানুষ। যদিও পুলিশের দাবি ছিনতাই রুখতে তারা যথেষ্ট তৎপর রয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর ৪৯টি থানার আটটি ডিভিশনাল জোনে চিহ্নিত প্রায় ১৩৫টি ছিনতাই স্পট রয়েছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে ২৫টি চিহ্নিত গ্রুপ। আবার তারাই চুরি ও ছিনতাই করা পণ্য ঢাকার চোরাই মার্কেটগুলোতে সরবরাহ করছে।
মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, ফকিরাপুল, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদসহ আশপাশের এলাকার চিহ্নিত ছিনতাইকারী ও তাদের গ্রুপের সদস্যদের অবাধ বিচরণ রয়েছে এসব মার্কেটে।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম, উত্তরা পূর্ব থানা এলাকা, বাড্ডা, বনানী, খিলক্ষেত, ভাষানটেক, মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, দারুস সালাম, নিউ মার্কেট, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, গুলিস্তান, রামপুরা, হাজারিবাগসহ মহানগরীর থানা এলাকায় প্রায় একশ’ ছিনতাই স্পটে মোটরসাইকেলে, মাইক্রোবাসে ও অতর্কিত হামলা চালিয়ে নগদ টাকা ছিনতাই হচ্ছে।
ডিএমপির আটটি ক্রাইম জোনের এসব ছিনতাই স্পটে সক্রিয় রয়েছে কয়েক ডজন ছিনতাইকারী চক্র। এদের মধ্যে মিরপুর ১ নম্বর গোলচত্বর থেকে টেকনিক্যাল মোড় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করছে ছিনতাইকারী চক্রের একটি গ্রুপ।
মেরুল বাড্ডা, রামপুরা মহাখালী, গুলশান, পান্থপথ, ফার্মগেট, মতিঝিল, ওয়ারি, মৌচাক, হাতিরঝিল, শান্তিনগর, কাকরাইল, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া, বাবুবাজার, রাজারবাগ, কমলাপুর, ধানমন্ডি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গড়ে উঠেছে এলাকাভিত্তিক ছিনতাইকারী চক্রের গ্রুপ।
পুলিশ ও গোয়েন্দাদের তালিকায় রাজধানীতে যেসব ছিনতাই চক্র তৎপর, তাদের মধ্যে রয়েছে বাড্ডার সোহেল, গুলশানের নাসির, ল্যাংড়া বাচ্চু, কাইল্যা সেন্টু, মিরপুরের আকতার, এতিম মনির, ইমু, জাকির, আরিফ, সুলতান, জাহাঙ্গীর ও সাগর গ্রুপ।
মিরপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া ও উত্তরায় ছিনতাইকারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে খলিফা গ্রুপ। মতিঝিল ও ওয়ারি এলাকার নেতৃত্বে রয়েছে মকবুল গ্রুপ।
প্রতিটি গ্রুপে ১০-১২ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছেন। আর প্রত্যেক দলের রয়েছে একাধিক মোটরসাইকেল। ছিনতাই শেষে মালামাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে পৌঁছে দিতে মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন তারা।
গুলিস্তানের ব্যবসায়ীরা জানান, শুধুমাত্র স্টেডিয়াম মার্কেটকে ঘিরেই সক্রিয় রয়েছে অর্ধশতাধিক চোর ছিনতাইকারী, যাদের অধিকাংশই দেখতে স্মার্ট ও ভদ্র। তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই, এরা সত্যিই চোর! এদের ১০-১২ জনের কয়েকটি গ্রুপ এলাকাভিত্তিক মোবাইল চুরি/ছিনতাই করে।
প্রতিটি গ্রুপেই একজন করে নেতা থাকেন। চোরাই মার্কেটগুলোর ব্যবসায়ী এবং প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তারা। গুলিস্তান, মতিঝিল, নবাবপুর, কাপ্তানবাজার, পল্টন, কাকরাইল, বঙ্গবাজার, ফুলবাড়িয়া, নিমতলি, সদরঘাট, বাবুবাজার, কামরাঙ্গীরচর, ফকিরাপুল প্রভৃতি এলাকায় বিশেষভাবে সক্রিয় রয়েছে এসব চক্র।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘ছিনতাইরোধে পুলিশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চিহ্নিত ছিনতাই স্পটগুলোতে পুলিশের গাড়ি ছাড়াও নিয়মিত মোটরসাইকেলে টিম টহল দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করা হচ্ছে। যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে, সেটির পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে।’
গত দুই সপ্তাহে ছিনতাইয়ের খণ্ডচিত্র
পুলিশ পরিচয়ে অহরহ ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। গত ১৭ অক্টোবর মঙ্গলবার মধ্যরাতে রাজধানীর খামারবাড়ি এলাকায় হিমেল খান নামে বিদেশগামী এক ব্যক্তির গাড়ি থামিয়ে দুটি মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সা ও সঙ্গে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায় জসিম উদ্দিন নামে পুলিশের এক উপ-পরিদর্শক।
পরে তারা ছিনতাইকারী বলে চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন ওই পুলিশ কর্মকর্তা ও তার সঙ্গে থাকা অপর ব্যক্তি মিঠুকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।
একই দিন ডিবি পরিচয়ে ছিনতাই করতে গিয়ে জয়পুরহাটে ধরা পড়েন ছয় ব্যক্তি।
অন্যদিকে একই দিন দিনগত রাত তিনটার দিকে রাজধানীর হাজারীবাগের বেড়িবাঁধ এলাকায় ছিনতাইকারী ধরতে গিয়ে আহত হন পুলিশের উপ-পরিদর্শক ইমতিয়াজ ও কনস্টেবল গোলাম আজম।
গত ৮ অক্টোবর টিকাটুলি এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে প্রাণ হারান ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী খন্দকার আবু তালহা। ১৯ অক্টোবর ধানমন্ডিতে মিনহাজ উদ্দিন নামে এক নিরাপত্তাকর্মীকে কুপিয়ে মোটরসাইকেল ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। পরে তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ছিনতাইয়ের মালামাল বিকিকিনির হাট
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ছিনতাইকারীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ছিনতাইকৃত মালামাল গুলিস্তান পাতাল, স্টেডিয়াম, ওসমানি উদ্যান, বঙ্গবাজার, ফকিরাপুল এবং পল্টনের বিভিন্ন চোরাই মার্কেটের দোকানগুলোতে সরবরাহ করে থাকে।
ঢাকার চোরাই মার্কেটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ইলেক্ট্রনিক্স মার্কেট হচ্ছে ভাসানী হকি স্টেডিয়াম। ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি, ভিসিডি, মোবাইল ফোন, টেলিফোন, ক্যালকুলেটর, ঘড়ি, দেশি-বিদেশি লাইটার থেকে শুরু করে এমন কোনো ইলেক্ট্রনিক্স জিনিস নেই, যা এখানে পাওয়া যায় না।
দোকানগুলো সারাদিন খোলা থাকলেও দিনের আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে বেচাকেনা জমে উঠতে শুরু করে। চলে রাত ১১টা পর্যন্ত।
আরেকটি চোরাই মার্কেট হলো- গুলিস্তান পাতাল মার্কেট। এখানে শ’খানেক মোবাইল ফোনের দোকান রয়েছে। দোকানগুলোতে মূলত পুরনো ফোনই বেশি বিক্রি হয়। তবে এখান থেকে একবার যারা মোবাইল কেনেন, তারা আর কখনও কিছু কিনতে আসেন না।
এছাড়া ভেজাল মোবাইল ফোন পার্টস ও এক্সেসোরিজের অন্যতম মার্কেট এটি। ভাল মোবাইল ফোনের পার্টস বদলে ভেজাল পার্টস লাগিয়ে বিক্রি করা হয় এখানে।
কোনো যানবাহন চুরি কিংবা ছিনতাই হলে প্রথমেই যে নামটি চলে আসে সেটা ধোলাইখাল। এখানে স্বল্পমূল্যে অনেক মূল্যবান যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়। এখানে আগে প্রকাশ্যে চোরাই যন্ত্রাংশের হাট বসলেও এখন এ ব্যবসা চলে গোপনে।
লালমোহন স্ট্রিটের বেশ কয়েকটি দোকানে টাটা মিতসুবিশি ও হিনো গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রি হয় অবৈধভাবে। একই রোডের মসজিদ মার্কেটের পরের দুই পাশের দোকানগুলোতেও পাওয়া যায় চোরাই যন্ত্রাংশ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন