যান চলাচল সহজ করতে গত দেড় দশকে ঢাকায় সাতটি ফ্লাইওভার নির্মাণ হলেও যানজট নিরসনে সেগুলো কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না; বিপুল অর্থ খরচ করে এই অবকাঠামো গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।
তারা বলছেন, প্রকৃত উন্নয়নের চেয়ে ‘অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে দৃশ্যমান উন্নয়নে’ নজর থাকায় একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু নগরবাসীর চলাচলে স্বস্তি আনতে স্ট্রাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান-এসটিপিতে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল তার বাস্তবায়ন হচ্ছে উল্টোপথে।
গণপরিবহন প্রকৌশল ও সড়ক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যানজট নিরসনে ফ্লাইওভার যে ততোটা কার্যকর হবে না, তা নীতিনির্ধারকরাও জানতেন।
“ঢাকা শহরের পরিবহন পরিকল্পনায় এক যুগ আগে প্রণীত এসটিপিতে ফ্লাইওভার ছিল সবার শেষে। সেখানে আগে যেসব বিষয় করার কথা ছিল, সেগুলোতে নজর দেওয়া হয়নি।”
উন্নয়ন কাজে সমন্বয়হীনতার কথা স্বীকার করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনও।
তবে সড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলছেন, সব চলছে পরিকল্পনামাফিক, কোথাও ব্যত্যয় ঘটেনি।
কী ছিল এসটিপিতে
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ২০০৫ সালে প্রথম এসটিপি প্রণয়ন করে, যার উদ্দেশ্য ছিল ২০১৫ সালের মধ্যে ঢাকা মহানগর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য পরিকল্পিত ও সমন্বিত আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এরপর ২০১৫ সালে এসটিপি সংশোধন করে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা করা হয়।
২০০৫ সালের এসটিপিতে থাকা সবগুলো ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার এবং বনানী রেলওভার পাস, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার,বিজয় সরনি-তেজগাঁও সংযোগ সড়ক এবং মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার।
ঢাকায় যানজটের এই চিত্র নিত্যদিনের ঢাকায় যানজটের এই চিত্র নিত্যদিনের এসটিপিতে তিনটি বাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট লাইন উত্তরা-কুড়িল-সায়েদাবাদ (বিআরটি-১), গাবতলী-সায়েদাবাদ (বিআরটি-২), এয়ারপোর্ট-সায়েদাবাদ (বিআরটি-৩) এবং তিনটি মাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট লাইন উত্তরা-সায়েদাবাদ (এমআরটি-৪), অর্ধবৃত্তাকার (এমআরটি-৫) এবং মিরপুর-সায়েদাবাদ (এমআরটি-৬) বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছিল।
এসব প্রকল্পের কোনোটিতেই শুরুতে হাত দেওয়া হয়নি। আরএসটিপিতে বাকিগুলো বাদ দিয়ে বিমানবন্দর- সায়েদাবাদ বিআরটি সম্প্রসারিত করে কাপাসিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটির কাজ শুরু হয়েছে।
সংশোধিত এসটিপিতে ৫টি এমআরটি করার সুপারিশ করা হয়েছে। গাজীপুর হতে ঝিলমিল পর্যন্ত এবং পূর্বাচল থেকে কুড়িল বিশ্বরোড মিলিয়ে এমআরটি-১, আশুলিয়া-সাভার-গাবতলী-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-গুলিস্তান হয়ে কমলাপুর এমআরটি-২, কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এমআরটি-৪, ভুলতা থেকে শুরু হয়ে বাড্ডা-মিরপুর রোড-মিরপুর ১০-গাবতলী-ধানমণ্ডি হয়ে হাতিরঝিল লিংক রোড পর্যন্ত এমআরটি-৫-এর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এসটিপিতে থাকা এমআরটি-৬ মিরপুর থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত প্রস্তাব করা হলেও আরএসটিপিতে তা আশুলিয়া পর্যন্ত নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে এই প্রকল্পের।
এছাড়া তিনটি রিং রোড, আটটি রেডিয়াল সড়ক, ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে, ২১টি ট্রান্সপোর্টেশন হাব রাখা হয়েছে আরএসটিপিতে।
ঢাকার চারপাশের বৃত্তাকার জলপথ উন্নয়ন,ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং বাস পরিবহন ব্যবস্থা পুনর্গঠনের কথা বলা হয়েছে এতে।
হালের চিত্র
ফ্লাইওভারে যে যানজট কমছে না তা আরও স্পষ্ট হয়েছে সপ্তাহ দুয়েক আগে ঢাকার কেন্দ্রস্থলে মৌচাক-ফ্লাইওভার পুরোপুরি চালু হওয়ার পর।
চলাচলকারীরা বলছেন, ফ্লাইওভার হওয়ায় যানজটের স্থান বদল হয়েছে, কিন্তু যাতায়াতে সময় লাগছে আগের মতোই।
এছাড়া ২০১০ সালে চালু হওয়া তেজগাঁও-বিজয় সরণি ফ্লাইওভারে সারাদিনই গাড়ির জট লেগে থাকে। যানজট হয় ২০১৩ সালে চালু মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের গুলিস্তান ও চাঁনখারপুল নামার পথেও।
মগবাজার ফ্লাইওভারের বাংলামটর প্রান্তে নামার পথেই পড়তে হচ্ছে দীর্ঘ যানজটে মগবাজার ফ্লাইওভারের বাংলামটর প্রান্তে নামার পথেই পড়তে হচ্ছে দীর্ঘ যানজটে মহাখালীতে দেশের প্রথম ফ্লাইওভারের দুইপাশে নামার পথেও যানজট নিত্যসঙ্গী। খিলগাঁও ফ্লাইওভারের গোড়াতেও প্রায়ই যানজট লাগছে।
অধ্যাপক শামসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আমাদের শহরকে পথচারীবান্ধব, গণপরিবহনবান্ধব করিনি। আমরা সিস্টেমে বিশ্বাস করি না। আমরা খরচ না করে উন্নয়ন চাই না। আমরা খরচ করে উন্নয়ন করতে পছন্দ করি।”
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ফ্লাইওভারে ছোট ছোট যানবাহন যাতায়াত করে। এছাড়া দূরপাল্লার কিছু বাস ফ্লাইওভারে ওঠে। এই কমসংখ্যক মানুষের পরিবহনের উন্নয়নে অনেক বেশি টাকা খরচ করা হচ্ছে।
একটি শহরের পরিবহন ব্যবস্থা আধুনিক ও জনবান্ধব করতে হলে পথচারীদের চলাচল এবং গণপরিবহনের উপর সবার আগে জোর দিতে হয় বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক শামসুল হক।
“পথচারীই প্রথম-এই মূলমন্ত্র ধরে পথচারীদের চলাচল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যাতে ছোট ছোট ট্রিপগুলো হেঁটেই যেতে পারে। আরেকটু দূরের যাত্রা হলে আলাদা আলাদা না গিয়ে পথচারীবান্ধব দ্রুতগতির নির্ভরযোগ্য গণপরিবহনে যেতে পারেন।”
‘ফ্লাইওভার সমাধান নয়’
হাতিরঝিলের এরিয়া ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড বিল্ডিং ডিজাইন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি মনে করেন, ফ্লাইওভার ঢাকার যানজট সমস্যা সমাধান করতে পারবে না।
সরকারি একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার রাস্তায় নাগরিকদের ‘ট্রিপ’ হয় দিনে গড়ে সাড়ে তিন কোটি। এসব ‘ট্রিপের’ ৪৭ শতাংশের দূরত্ব দেড় থেকে দুই কিলোমিটার।
এ ধরনের শহরে ফ্লাইওভার কখনোই উপযুক্ত প্রকল্প নয় বলে মন্তব্য করেন ইকবাল হাবিব।
তিনি বলেন, “এসটিপি বা আরএসটিপি সরকার নিজেই তৈরি করেছে। ফ্লাইওভার যে সমাধান নয়- তা সেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে। বলা আছে-বাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট, রেল কমিউটার সিস্টেম অথবা নৌপথের মিলিত পদ্ধতির পাশাপাশি পথচারীদের নিরবিচ্ছন্ন যাতায়াত হল সমাধান।”
হাজার কোটি টাকার বেশি খরচের মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মাণে আড়াই বছরের জায়গায় লেগেছে ছয় বছর, যাতে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয় স্থানীয়দের হাজার কোটি টাকার বেশি খরচের মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মাণে আড়াই বছরের জায়গায় লেগেছে ছয় বছর, যাতে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয় স্থানীয়দের সব সমীক্ষায় পথচারী ও গণপরিবহনবান্ধব প্রকল্পের কথা বলা হলেও এর উল্টোটা হয়েছে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
“আমরা করছি ঠিক উল্টোটা। কারণ কাজের বেলায় আমাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পায় পুঁজিনির্ভর প্রকল্প, অনেক বেশি দৃশ্যমান উন্নয়ন। এগুলো কোনো কার্যকর ফল দেবে না এটা বলাই বাহুল্য।”
তিনি বলেন, “ফ্লাইওভার ব্যক্তিগত গাড়িকে সার্ভ করে। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ লোক চলাচল করে সেখানে মানুষ অনুপাতে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারী মাত্র ৮ শতাংশ।”
কর্তৃপক্ষের ভাষ্য
পরিবহন পরিকল্পনায় ততোটা গুরুত্ব না পেলেও ফ্লাইওভার আগে করা হল কেন জানতে চাইলে ডিটিসিএর সাবেক নির্বাহী পরিচালক এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, ঢাকায় যানবাহন চলাচলের জন্য জায়গা কম, গাড়ি বেশি। জায়গা বাড়ানোর জন্য ফ্লাইওভারের বিকল্প ছিল না।
“জায়গা বাড়ানোর একটাই উপায় ছিল, সড়কের ওপর আরেকটা সড়ক নির্মাণ করা।”
তবে ফ্লাইওভারে ওঠানামার পথগুলোয় সমস্যা থাকায় ঢাকার ফ্লাইওভারগুলো কাজে আসছে না বলে স্বীকার করেন তিনি।
“ফ্লাইওভারের দুই প্রান্তে গাড়িগুলো কীভাবে ম্যানেজ করবে সেই আরটারি রোড, পকেট রোড এবং সাইড রোড যেগুলো মেইন রোডে এসে মিলেছে সেগুলোকে আগে ডেভেলপ করতে হবে। সেগুলো উন্নত না করে ফ্লাইওভার নির্মাণ হলে সেটা কোনো কাজে আসবে না। যেটা আমরা এখন দেখছি ঢাকার কিছু ফ্লাইওভারের ক্ষেত্রে।”
ডিটিসিএর বর্তমান নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আহম্মেদও মানছেন, ফ্লাইওভার যানজটের স্থায়ী সমাধান নয়। সেজন্য আরএসটিপিতে ফ্লাইওভার নির্মাণ নিরুৎসাহিত করে গণপরিবহনকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
“ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পের কাজ আগে থেকে শুরু হয়েছিল। এসটিপিতে যেগুলো ছিল সেগুলো কিছু কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। সেটারই কন্টিনিউইটি চলছে। এখন আমরা ফ্লাইওভারকে উৎসাহিত করছি না।”
তিনি বলেন, এখন সরকারের অগ্রাধিকার এমআরটি ও বিআরটি। এর মধ্যে এমআরটি ও বিআরটির কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। বাকিগুলোও পর্যায়ক্রমে হবে।
ঢাকার দীর্ঘতম মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়াসহ ওই এলাকার বাসিন্দাদের শহরের কেন্দ্রস্থলে যাতায়াত সহজ করলেও এর নামার পথেও যানজট হয় প্রায়ই ঢাকার দীর্ঘতম মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়াসহ ওই এলাকার বাসিন্দাদের শহরের কেন্দ্রস্থলে যাতায়াত সহজ করলেও এর নামার পথেও যানজট হয় প্রায়ই সড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামের দাবি, এসটিপিতে থাকা সব প্রকল্পই ঠিকমতো এগোচ্ছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ফ্লাইওভারের সঙ্গে বিআরটি, এমআরটি সাংঘর্ষিক নয়, ওভারল্যাপিংয়ের কোনো বিষয়ও নেই। বিআরটি-এমআরটি বাস্তবায়নের যে কর্মপরিকল্পনা, সেটা সে কর্মপরিকল্পনার মধ্যেই আছে। কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।”
এসটিপিতে অগ্রাধিকারে থাকা এসব প্রকল্প শুরু হতে দেরির কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “ফ্লাইওভার আর বিআরটি-এমআরটির কাজ এক নয়। এমআরটি করতে গেলে অনেক বেশি সমীক্ষার, অনেক পরিকল্পনার বিষয় আছে।
“বিআরটি, এমআরটির মতো প্রকল্প শুরু করার আগে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হয়, এ কারণে এসব প্রকল্প শুরু করতেও কিছুটা দেরি হয়। তবে যে সময় দেওয়া আছে সে সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে।”
‘তালগোল’
রাজধানীর পরিবহন খাতে সমস্যার জন্য উন্নয়নকাজে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় একটা নৈরাজ্য চলছে। কোনো একটা সংস্থা একটা উদ্যোগ নিলে আরেকটা সংস্থা জানেই না। এই যে একটা তালগোল পাকিয়ে আছে। আমরা এখনও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে পারিনি।”
এ কারণে ঢাকার সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে একটা ছাতার নিচে আনা দরকার মনে করছেন সাঈদ খোকন।
“একটা বডি থাকবে উইথ অথরিটি, যারা এসব উন্নয়নকাজ করবে। তাহলে সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে।”
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন