তিন চাকার বাহন রিকশা। স্বল্প ভাড়ায় রাজধানীবাসীর অন্যতম ভরসা। রাজধানীর প্রায় পৌনে সাত লাখ রিকশার মধ্যে ছয় লাখই অবৈধ। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সহায়তা এগুলো রাজপথে চলছে। এ জন্য অবৈধ রিকশার মালিকদের প্রতি মাসে রিকশাপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা সংগঠনগুলোকে দিতে হয়। অবৈধ রিকশা উচ্ছেদে এই সংগঠনগুলোই মূল বাধা। প্রতিবছর এই সংগঠনগুলো রিকশা মালিকদের কাছ থেকে প্রায় ১২ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে।
অন্যদিকে, রাজধানীতে বৈধ রিকশার সংখ্যা মাত্র ৮০ হাজার। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন প্রতিবছর লাইসেন্স নবায়নের জন্য রিকশাপ্রতি ১০০ টাকা করে নিয়ে থাকে। অর্থাৎ, বিভিন্ন সংগঠন যেখানে অবৈধ রিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে বছরে ১২ কোটি টাকা আয় করছে, সেখানে লাইসেন্স নবায়নে করে দুই সিটি করপোরেশন বৈধ রিকশার কাছ থেকে বছরে আয় করছে মাত্র ৮০ লাখ টাকার কিছু বেশি।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, পুরো রাজধানীতে ৮০ হাজার ৪৭৩টি রিকশার লাইসেন্স রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ৫২ হাজার ৭৫৩ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় ২৬ হাজার ৭২০টি রিকশার লাইসেন্স রয়েছে। লাইসেন্সধারী রিকশাগুলোর প্রতিবছর লাইসেন্স নবায়ন করাতে হয়। এ জন্য সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, রিকশাপ্রতি ১০০ টাকা নবায়ন ফি দিতে হয়। লাইসেন্সবিহীন রিকশার একেবারে সঠিক সংখ্যা কারও কাছেই নেই। তবে পুলিশ, রিকশা মালিক-শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন ও সিটি করপোরেশনের মতে, রাজধানীতে এ ধরনের অবৈধ রিকশার সংখ্যা প্রায় ছয় লাখের মতো।
রাজধানীতে এখন আর নতুন করে রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয় না। কিন্তু বিভিন্ন সংগঠনের নামে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ রিকশা চলছে। ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা এসব রিকশা সংগঠন পরিচালনা করে থাকেন। এঁদের চাপের কারণে নগরী থেকে অবৈধ রিকশা উচ্ছেদ করা সম্ভব হয় না বলে জানান ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীতে রিকশা বন্ধ করা যায়নি। বরং প্রতিদিনই রিকশার সংখ্যা বাড়ছে। যেহেতু রাজধানীতে রিকশা চলাচল বন্ধ করা যায়নি, তাই সিটি করপোরেশন লাইসেন্স দিলে বরং সরকারের রাজস্ব বাড়ত। ছয় লাখ রিকশার লাইসেন্স সিটি করপোরেশন দিলে প্রতিবছর ছয় কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়া যেত। এখনো রিকশার মালিকেরা বছরে লাইসেন্স নবায়নের চেয়েও বেশি টাকা চাঁদা দিচ্ছেন।
রাজধানীতে যেসব রিকশা চলাচল করছে, এর বেশির ভাগই কোনো না কোনো সংগঠনের অধীন। সেসব সংগঠনের নম্বর প্লেট রিকশাগুলোর পেছনে লাগিয়ে রাখা হয়। রিকশার মালিকেরা সাধারণত ১০টি থেকে ২০টি রিকশা ভাড়া দিয়ে থাকেন। অনেকে আবার নিজেরাই রিকশা কিনে চালিয়ে থাকেন। নম্বর প্লেট না থাকলে রাস্তায় চলতে বাধার মুখে পড়তে হয়। পুলিশ অথবা সংগঠনের নেতারা উচ্ছেদের নামে রিকশা তুলে নিয়ে ডাম্পিংয়ে পাঠিয়ে দেন। মিরপুরের এক রিকশাচালক বলেন, পুলিশ নিয়ে গেলে সমিতির নেতাদের টাকা দিয়ে রিকশা ছাড়িয়ে আনতে হয়।
বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সহায়তায় রাজধানীর রাজপথে অবৈধ রিকশা চলছে। ছবি: প্রথম আলো
বড় সংগঠনগুলোর সদস্য হতে হলে রিকশাপ্রতি মাসে ২০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। ছোট সংগঠনের চাঁদা প্রতিটি রিকশার জন্য ৫ থেকে ১৫ টাকা করে দিতে হয়। এলাকার গুরুত্ব ওপর চাঁদা নির্ধারণ করা হয়। চাঁদার বিনিময়ে প্রতিটি রিকশার জন্য একটি নম্বর প্লেট দেওয়া হয়। গড়ে প্রতি মাসে ১৫ টাকা করে ধরলে সাড়ে ছয় লাখ রিকশা থেকে বিভিন্ন সংগঠন বছরে আয় করে ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর সিটি করপোরেশন লাইসেন্স করা ৮০ হাজার ৪৭৩টি রিকশা থেকে বছরে ৮০ লাখ ৪৭ হাজার ৩০০ টাকা পায়।
রাজধানী ঢাকায় প্রায় ৩১ বছর আগে ১৯৮৬ সালে শেষবারের মতো পায়ে চালানো রিকশা ও ভ্যানের লাইসেন্স দিয়েছিল সেই সময়ের অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন। এ তথ্য জানিয়ে ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার প্রথম আলোকে বলেন, রিকশা চলাচল নিরুৎসাহ করতে দীর্ঘ তিন দশক ধরে এসব রিকশার লাইসেন্স শুধু নবায়ন করে চলছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।
অবৈধ রিকশা চলাচলের কারণে রাজস্ব আদায়ে ক্ষতি হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ট্রাফিক বিভাগ অবৈধ রিকশা উচ্ছেদ করে থাকে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযানের সময় একজন প্রতিনিধি দেওয়া হয়। নতুন করে রিকশার লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের উচ্চপর্যায়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো নির্দেশ না আসায় নতুন লাইসেন্স দেওয়া যাচ্ছে না।
ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা রবীন্দ্র শ্রী বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, রিকশার আধিক্যের কারণে যানজট সৃষ্টি হয়। এ কারণে রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। ভবিষ্যতেও নতুন করে রিকশার লাইসেন্স প্রদানের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানান তিনি।
রাজধানীর বেশির ভাগ রিকশাচালক ভাড়ায় রিকশা চালান। সাতক্ষীরার মো. সুমন ঢাকায় তিন বছর ধরে রিকশা চালান। তাঁর রিকশাটি জিগাতলা টালি অফিস এলাকার একটি গ্যারেজের। প্রতিদিন তিনি গ্যারেজ মালিককে ১০০ টাকা দেন। সেখানে ৭০টি রিকশা আছে।
ঢাকা শহরে বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশনের রিকশা বেশি চলাচল করে। এই সংগঠনের নম্বর প্লেটে যুক্ত মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে মো. মনজু নামে এক ব্যক্তি কথা বলেন। নতুন রিকশা চলাচলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা-দুইটা, পাঁচ-দশটা রিকশা হইলে চলব না। কম কইরা ২০টা রিকশা যেই মালিকের আছে, তিনি আমাগো সদস্য পাইবেন। একটা রিকশার জন্য মাসে ২০ টাকা করে আমাগো কাছে মালিকরে দিতে হয়।’
অবৈধ রিকশার মালিকদের কাছ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১২ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে বিভিন্ন সংগঠন। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা সিটি মুক্তিযোদ্ধা রিকশা-ভ্যান মালিক কল্যাণ সোসাইটির নেমপ্লেটযুক্ত রিকশাও চলে। এ সমিতির একজন শুকুর আলী বলেন, তাঁদের অধীনে ঢাকায় ১০ হাজার রিকশা আছে। লাইসেন্স না দেওয়ায় এ সংগঠনের নেমপ্লেট নিয়ে রিকশা নামান তাঁদের সদস্যরা। শুকুর আলী নিজেও বলেন, সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। তবে তাঁরা সিটি করপোরেশনে চিঠি দিয়েছেন নতুন করে লাইসেন্স করার জন্য। সড়কে পুলিশের আটকানোর ব্যাপারে বলেন, তেমন কিছু বলে না।
অবৈধ রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান সব সময় চলছে বলে জানান ঢাকা মহানগর ট্রাফিক বিভাগের (পশ্চিম) লিটন কুমার সাহা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যেসব সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ, সেখানে ট্রাফিক বিভাগ অভিযান চালায়। অবৈধ রিকশা আটক করে ডাম্পিং করা হয়। ধ্বংস করে এসব রিকশা ফেলে দেওয়া হয়। ট্রাফিক বিভাগ অবৈধ রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে, সংগঠনের বিরুদ্ধে নয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন