ছুটির পর রাজধানীর গণভবনের ফটকের সামনে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ৬ষ্ঠ শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী অতনু ও মাহিম। কিছুক্ষণ পর বিআরটিসির একটি স্কুল বাস সিগনালে এসে দাঁড়ায়। খানিকটা ইতস্তত হয়েই তারা বাসটিতে উঠলেন। অতনু বলেন, ‘স্কুলবাস আজকেই দেখলাম। কখন কোথা থেকে আসে তা জানি না। অধিকাংশ সময় বাবার সাথে স্কুলে আসলেও অনেক সময় একাই আসি।’
আবার স্কুলবাসের কথা জানলেও তাতে ওঠার কোনো সুযোগ থাকে না বলে অভিযোগ করেন ফাতেমা বেগম। ফলে কল্যাণপুর থেকে নিয়মিত তিনি লোকাল বাসে করেই শুক্রাবাদে নিউ মডেল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যান। স্কুলবাস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সকালে মিরপুর থেকে একটা স্কুলবাস আসে। কিন্তু তাতে জায়গা থাকে না। মিরপুর থেকেই ভর্তি হয়ে আসে। তাই বাধ্য হয়েই অন্য বাস ব্যবহার করতে হয়। তাছাড়া স্কুলবাসে কল্যাণপুর থেকে উঠলেও মিরপুরের ভাড়াই দিতে হয়।’
রাজধানীতে স্কুলবাসের চাহিদা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে বাধ্য হয়ে লোকাল বাসে চলাচল করেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। ২০১১ সালে খানিকটা ঘটা করেই চালু হয় এই স্কুলবাস সার্ভিস। স্কুলগামী শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সুবিধার্থে আলাদা বাসস্টপেজের সাইনবোর্ডও লাগানো হয়, যেখানে শিক্ষার্থীদের ওঠা-নামা করার জন্য শুধু স্কুলবাস থামার কথা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিসি) ১৪টি বাস নিয়ে এই সার্ভিস চালু করলেও বর্তমানে চলছে মাত্র দুটি। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অজুহাত লোকসান।
মিরপুর ১২ নম্বর থেকে মিরপুর ১০, ১, টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আসাদগেট, কলাবাগান, নিউমার্কেট হয়ে আজিমপুর রুটে চলে বাস দুটি। এতে ২৬টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা যাতায়াত সুবিধা পান।
শুরুতে ব্যাপক সাড়া ফেলা এই বাস সার্ভিসটির গাড়ি সংখ্যা কমে এখন মাত্র দুটি হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় রয়েছে অসংখ্য স্কুল। প্রতিদিনই এসব স্কুলের শিক্ষার্থীদের যাতায়াত নিয়ে রীতিমত নাকানি-চুবানি খেতে হয় অভিভাবকদের। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের কারণে সড়কে বাড়তি চাপ পড়ে তৈরি হয় যানজট। সেখানে কেন স্কুলবাস সার্ভিসে নতুন বাস যুক্ত হওয়ার বদলে কমেছে? এমন প্রশ্ন অভিভাবকদের মনেও রয়েছে।
তবে প্রত্যাশিত যাত্রী না পাওয়াকে এর কারণ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে সম্পূর্ন ভিন্ন চিত্র। অনেক অভিভাবকই চাইলেও ব্যবহার করতে পারছেন না সরকারি পরিবহন সংস্থার এই বাস সার্ভিসটি। আবার অনেকে জানেন-ই না স্কুলবাস সার্ভিসের কথা! এজন্য সঠিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা। তবে এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ।
মিরপুর-আজিমপুর রুটে দেখা গেছে, স্কুলবাসে যাত্রী না পাওয়ার যে অজুহাত দেখাচ্ছে বিআরটিসি তার কোনো ভিত্তি নেই। মিরপুর ১২ থেকে ছেড়ে আসা স্কুলবাস বাঙলা কলেজ সংলগ্ন আনসার ক্যাম্প বাসস্টপেজে পৌঁছতেই সব আসন পূর্ণ হয়ে যায়। এর পরের স্টপেজগুলো থেকে ওঠা যাত্রীদের সমস্ত পথ দাঁড়িয়ে যেতে হয়েছে।
শ্যামলীতে বাস থামার সময়সূচি
কলাবাগান বাসস্টপেজের সামনে সন্তান নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন জোবায়ের হোসেন। স্কুলবাসের কথা বলতেই তিনি বলেন, ‘স্কুলবাস কোথায় দেখেন? এই রুটে স্কুলবাস লাগে ৪টা। সেখানে বোধ হয় একটা চলে (প্রকৃতপক্ষে চলে দুইটা)। স্বাভাবিক কারণেই তাতে সিট থাকে না। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ও তাদের দরকারের কথা বিবেচনা না করার কারণেই সার্ভিসটির এ অবস্থা।’ কথা বলতে বলতেই সন্তানকে নিয়ে তিনি অন্য একটি বাসে কোনোরকম উঠে যান।
আবার অনেক অভিভাবক ইচ্ছে করেই স্কুলবাসে নিজের সন্তানকে দিতে চান না। তাদের প্রশ্ন, ব্যক্তিগত গাড়ি থাকতে কেন তাদের বাচ্চারা স্কুলবাসে যাবে? আজিমপুরে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে মেয়েকে ব্যক্তিগত গাড়িতে পৌঁছে দেন আনোয়ার হোসেন। মিরপুর ২ নম্বর থেকে অফিসে যাওয়ার পথে প্রতিদিন মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে যান তিনি। এই রুটে তো স্কুলবাস চলাচল করে তাহলে তাতে মেয়েকে দেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার তো নিজের গাড়ি আছে। তাহলে আমার বাচ্চা কেন বাসে যাতায়াত করবে? এতে আমার বাচ্চার নিরপত্তা কে দেবে?’
এদিকে বাসচালক জানান, যাতায়াতকারীরা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম দেন। এ বিষয়ে স্কুলবাস সার্ভিসের চালক মো. হাবিব প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আসলে বাসে যাতায়াতকারীরা ভাড়াটা একরকম নির্দিষ্টই করে নিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা দেয় ৫ টাকা আর অভিভাবকরা দেন ১০ টাকা। তবে নির্ধারিত ভাড়া এর থেকে বেশি।’
একাধিক অভিভাবক স্কুলবাসের সময়সূচি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তাদের অভিযোগ, ভোরের স্কুলবাসটি ছাড়া হয় অনেক আগে। ঘুম থেকে ওঠে এত তাড়াতাড়ি সন্তানকে নিয়ে আসা সম্ভব না বলে দাবি তাদের।
বিআরটিসির মিরপুর দ্বিতল বাস ডিপোর ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামান প্রিয়.কমকে জানান, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬টায় মিরপুর ১২ নম্বর থেকে একটি বাস ছাড়ে। অপরটি ছেড়ে যায় বেলা ১১টায়। তবে পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের সুবিধা অনুযায়ী সময় নির্ধারণ করা হয়।
নিয়মিত স্কুলবাস সার্ভিস ব্যবহার করেন মিরপুরের আনসার ক্যাম্প এলাকার বাসিন্দা জিনাত রিতা। ২০১১ সাল থেকেই এতে সন্তানদের নিয়ে চলাচল করছেন তিনি। সন্তানদের আনা-নেওয়ায় স্কুলবাস তাকে দারুন সহযোগিতা করে বলে জানান তিনি।
রিতা বলেন, ‘স্কুলবাসে যাতায়াত করলে অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকা যায়। ওঠা-নামার ক্ষেত্রে চালক সহযোগিতা করেন। আর এখানে ভাড়া নিয়েও তেমন ঝামেলা করেন না চালকরা। স্কুলবাসে নিয়মিত যাতায়াতকারীদের সংখ্যাই বেশি। অনেক সময় দাঁড়িয়েও অনেকে যাতায়াত করেন।’
তাহলে কেন সবাই স্কুলবাস ব্যবহার করছেন না, আপনার কী মনে হয়? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের দেশে এখনও শ্রেণি বৈষম্য রয়েছে। অনেকেই সবার সাথে তাদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চান না। প্রথম দিকে তাদের বাচ্চাকে স্কুলে পাঠালেও পরে আবারও তারা অন্য উপায় ব্যবহার শুরু করেন।’
স্কুলবাস সার্ভিসের মতো একটি বাস্তবসম্মত উদ্যোগ কেন সফল হলো না? জানতে চাইলে বিআরটিসির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) মো. আলমাছ আলী জানান লোকসানের কথা। তিনি বলেন, ‘অনেকেই সময়মতো বাস ধরতে পারে না। তাছাড়া অনেকে বাচ্চাদের বাসে করে স্কুলে পাঠাতে চান না। ফলে কমতে থাকে যাত্রী সংখ্যা। আর একারণেই বাসের সংখ্যা কমানো হয়েছে।’
স্কুল বাস সার্ভিসের প্রচারণায় গাফিলতির অভিযোগ প্রসঙ্গে আলমাস আলী বলেন, ‘এ সার্ভিসের শুরু থেকেই বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রচারণা চলানো হয়েছে। এখন কেউ যদি তার সন্তানদের নিয়ে এতে না চলে, তাহলে তো কিছু করার নেই।’
বিআরটিসির একটি সূত্র জানায়, প্রতিদিন একটি স্কুলবাসে কেবল জ্বালানি বাবদ ব্যয় হয় ১২০০ টাকা। অথচ একটি বাস থেকে আয় হয় মাত্র ৯০০ টাকা। তাই প্রতিদিনই এই সার্ভিসের বাস দুটির জন্য লোকসান দিতে হয়। আর এ কারণেই কর্তৃপক্ষ সার্ভিসটির প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে।
স্কুলবাসের করুণ দশা সম্পর্কে বিআরটিসির চেয়ারম্যান ফরিদ আহমদ ভূঁইয়া প্রিয়.কমকে বলেন, ‘বিআরটিসির কাছে সবার অনেক প্রত্যাশা থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে এর সামর্থের দিকটাও দেখতে হবে। স্কুলবাসে নিয়মিত যাত্রী না পাওয়ার কারণে বাসের সংখ্যা কমানো হয়েছে। যাত্রী কমে যাওয়ার কারণে লোকসান হচ্ছিল। যাত্রী কমার সাথে ভাড়া নিয়েও অনেক ঝামেলার সৃষ্টি হয়। অনেক অভিভাবকও শিক্ষার্থীদের সমান ভাড়া দেন।’
তাহলে বিআরটিসি সেবার বদলে লাভের দিকে ঝুঁকছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকার আমাদের শুধু গাড়িগুলো কিনে দেয়। কিন্তু সার্বিক ব্যয় আমাদেরই বহন করতে হয়। এক্ষেত্রে লাভের কথা চিন্তা না করলেও অন্তত খরচের টাকাটা তো তুলতে হবে। নইলে বিআরটিসি চলবে কীভাবে।’
নতুন করে স্কুলবাস সার্ভিসে গাড়ি যোগ করা হবে কি-না জানতে চাইলে বিআরটিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘নতুন গাড়ি না আসার আগ পর্যন্ত স্কুলবাসের সংখ্যা বাড়ানোর সম্ভাবনা নেই। নতুন বাস আসলে চাহিদামতো অধিক সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।’
তবে রাজধানীর এত সংখ্যক শিক্ষার্থীর পরিবহনের দায়িত্ব বিআরটিসির একার পক্ষে বহন করা সম্ভব না বলে জানান তিনি। তাই বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব বাস কেনার ওপর জোর দেন ফরিদ আহমদ ভূঁইয়া।
‘উন্নত দেশগুলোর রাস্তায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একই রঙয়ের স্কুলবাস দেখা যায়। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাই মূখ্য। ঢাকায় অনেক বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের জন্য কয়েকটি বাস কেনা তেমন কোনো সমসা না। প্রতিষ্ঠানগুলো বাস কিনলে তাদের টেকনিক্যাল বিষয়টি বিআরটিসি কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান দিতে পারে’, যোগ করেন তিনি।
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্কুলবাসের ব্যবস্থা করলে স্কুল সময়ে ব্যক্তিগত গাড়ির অাধিক্য কমবে এবং এতে রাস্তার যানজটও সহনীয় মাত্রায় নামবে বলে দাবি করেন ফরিদ আহমদ।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন