‘রাস্তায় জ্যাম লাগলেই মোটরসাইকেল ফুটপাতে তুলে দিতে হবে! এরকম অসভ্যতা ও জঙ্গলিপনা বাংলাদেশের বাইরে আর কোথায় আছে?’ এভাবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আলতাফ পারভেজ নামের একজন ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ফুটপাতে মোটরসাইকেল তুলে দেওয়ায় তার মতো আরও অনেকের মধ্যেই ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। যানজটে কিনবা সিগনাল পড়লে ফুটপাতে মোটরসাইকেল তুলে দেন চালকরা। এতে মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকায় পথচারীদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনাও ঘটেছে।
পথচারীদের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য বলছেন, মোটরসাইকেল চালকদের মানসিকভাবে উন্নতি ঘটাতে হবে। না হলে শুধু মামলা দিয়ে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব না। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দুজন উপ-কমিশনার (ডিসি) দাবি করেন, ফুটপাতে মোটরসাইকেল ওঠে না।
রাজধানীর ফার্মগেট, খামারবাড়ি, গুলশান-১ ও ২, শুটিং ক্লাব, কারওয়ান বাজার, ধানমন্ডি, গুলিস্তানের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায়, যানজট থাকলে বা সিগনাল পড়লেই ফুটপাতে মোটরসাইকেল তুলে দেন চালকরা। বিকেলের পর ফুটপাতে মোটরসাইকেল তুলে দেওয়ার প্রবণতা বেশি। অনেক সময় ফুটপাতে রিকশা, সাইকেল, স্কুলভ্যানও তুলে দিতে দেখা যায়।
গুলশান-১ থেকে ২ এবং কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেট ঘুরে দেখা যায়, সড়কের দুই পাশের ফুটপাতে যেসব বাসা-বাড়ি, অফিস, শপিং-মল রয়েছে সেগুলোয় গাড়ি যাতায়াতের জন্য ফুটপাত নিচু করে রাখা আছে। আর সেইসব নিচু জায়গা দিয়েই মোটরসাইকেল তুলে দেন চালকরা।
সেসব ফুটপাতেই চালকরা গাড়ি তুলে দেন, যেগুলোয় খুব সহজে ওঠা-নামা করা যায়। তবে যেসব ফুটপাত উঁচু, খাড়া, খুঁটি পুতে রাখা আছে, সেগুলোয় মোটরসাইকেল উঠতে না পারায় পথচারীরা নিরাপদে হাঁটতে পারেন।
আনোয়ার খান মডার্ন কলেজের সামনের ফুটপাতে বসানো হয়েছে খুঁটি। ছবি: প্রিয়.কম
মিরপুর রোডের ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় ফুটপাতে চেয়ার-টেবিল নিয়ে চেকারের কাজ করেন মো. সুমন। তিনি বলেন, ‘ধানমন্ডি ২৭ থেকে ৩২ নম্বর পর্যন্ত ফুটপাত বেশ উঁচু। তাই এই ফুটপাতে খুব একটা উঠে না মরটসাইকেল। নিচু হইলে উঠত, সেইডা আপনারা দেখতাছেন, আমরাও দেখি। কিন্তু ফুটপাত দিয়া গাড়ি বা অন্য যানবাহন তুলে দেওয়া সমস্যা।’
ফুটপাতে মোটরসাইকেল কখনও তুলেছেন কিনা জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে এক মোটরসাইকেল চালক বলেন, ‘হ্যাঁ, কত তুলছি।’ তিনি বলেন, ‘যখন অনেক জ্যাম, তাড়া থাকে তখনই ফুটপাতে হুন্ডা তুলি। তা নাহলে তুলি না।’
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে কথা হয় এক রিকশাচালকের সঙ্গে। তিনি স্বীকার করেন, মাঝে মাঝেই ফুটপাতে রিকশা তুলে দেন। তিনি বলেন, ‘যাত্রীর জন্যই তো তোলা লাগে ফুটপাতে। যানজটে পড়লে যাত্রীরা বলে এইদিক দিয়া চল, ওইদিক দিয়া চল। ওদের তাড়া থাকে এ জন্যই তারা এইরকম করে।’
মোটরসাইকেল চালকদের ফুটপাতে উঠা ঠেকাতে মিরপুর রোডের আনোয়ার খান মডার্ন কলেজের সামনের ফুটপাতে লোহার কয়েকটি খুঁটি বসানো হয়েছে। এতে এখন আর এই ফুটপাতে চালকদের ইচ্ছে থাকলেও মোটরসাইকেল তুলতে পারেন না। এই পথে নিয়মিত চলাচলকারী মেহেদী হাসান বলেন, ‘শুধু ফুটপাতে তুলেই শেষ না। আপনাকে পেছন থেকে হর্ন দিয়ে কান ফাটিয়ে দিবে, আবার কিছু বললেও তেড়ে আসবে, এই হইল মোটরসাইকেল চালকরা। এদের মতো বেয়াদব চালক আর হয় না।’
তিনি বলেন, ‘ফুটপাত মানুষের নিরাপদে হাঁটার জন্য। কিন্তু মোটরসাইকেল চালকদের কারণে এখন রাস্তায় নেমে হাঁটতে হয়। কতটা অসভ্য হলে ফুটপাতে খুঁটি পুঁততে বাধ্য হয় পুলিশ, ভাবেন একবার।’
সড়ক থেকে ফুটপাতে মোটরসাইকেল তুলে দেওয়ার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। এই অবস্থার জন্য তারা দায়ী করছেন আইন না প্রয়োগ করাকে।
গুলশান-১ ও ২-এর মাঝামাঝি আগোরা এলাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এক পথচারী বলেন, ‘কাকে কী বলবেন, এটাই বাংলাদেশের নিয়ম।’
সড়কের সঙ্গে লাগোয়া ফুটপাত পেলেই মোটরসাইকেল তুলে দেন চালকরা। ছবি: প্রিয়.কম
আলতাফ পারভেজের ফেসবুকে দেওয়া ওই পোস্টে অনেকেই মন্তব্য করেন। যার একটির উত্তরে আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘হকাররা চলায় বাধাগ্রস্ত করে বটে, কিন্তু মেরে ফেলার উপক্রম করে না। বিকালের ফুটপাত মোটরসাইকেল চালকদের জন্য বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে এবং তাদের ঔদ্ধত্যও চরম অসভ্যতার স্মারক।’
সামিউল আলম রিচি নামে একজন মন্তব্য করেন, ‘শুধু তুলে দেয় না। ফুটপাতকে তাদের জমিদারী মনে করে ক্রমাগত হর্ন দিতে থাকে আর বেপরোয়াভাবে চালায়! পুরাই মাস্তানি!’
‘সেদিন আমার পেছনে হুট করে একজন এসে আমাকে চমকে দিছে। ইচ্ছা করেছিল জুতা দিয়ে পিটাই’, মন্তব্য এম এম ওবায়দুর রহমানের।
সেখানে জাহাঙ্গীর কবির লিখেন, ‘মোটরবাইক ব্যান করা উচিত।’ উত্তরে আলতাফ পারভেজ লেখেন, ‘মোটরসাইকেল তো সমস্যা না। সমস্যা তো চালকদের মাইন্ড সেট। অনেক চালক তো জ্যামেও রাস্তাতেই অপেক্ষা করেন।’
এর জবাবে সুমন মাহমুদ বলেন, ‘ডিএমপি আইনে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ দেশে আইন আদালত না মানার সংস্কৃতি চালু আছে।’
গুলশান-১ ও ২-এর মাঝামাঝি আগোরা এলাকায় বেলা ১১টার দিকে দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রাফিক সার্জেন্ট শাহাদাৎ। তিনি বলেন, ‘ফুটপাতে গাড়ি তুলে দেওয়া আইনত অপরাধ। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যারা ফুটপাতে গাড়ি তুলে দিচ্ছে আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করছি। আমাদের তো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ ঢাকা শহরে এত দীর্ঘ ফুটপাত, সব জায়গায় তো আর ট্রাফিক পুলিশ দেওয়া সম্ভব না। তাই যারা চালক তাদেরকে সচেতন হতে হবে।’
সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক পরিদর্শক সফিক বলেন, ‘আমাদের মধ্যে আইন মানার প্রবণতা কম, তাই এমনটা হয়। তারপরও ফুটপাতে গাড়ি তুলে দেওয়ার ফলে যে ঝুঁকি রয়েছে সেটা কমানোর জন্য আমরা তাদের জরিমানা, মামলা করছি। যাতে করে তারা এই ভয়ে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকে।’
সফিক আরও বলেন, ‘যখন যানজট লেগে যায় তখন ফুটপাতে যানবাহন তুলে দেওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। তরুণরা এই কাজ বেশি করে। তারা মনে করে, যা হয় হোক, আমাকে আগে যেতে হবে। তবে জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলে আমরা অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন পথ দেখিয়ে দেই। যানজটের মধ্যে গাড়ি ফুটপাতে উঠিয়ে দিয়ে যে খুব বেশি পথ যাওয়া যায় তা নয়, এটা আসলে মানসিকতার সমস্যা। এই মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।’
ডিএমপির ট্রাফিক পূর্ব বিভাগের উপকমিশনার ড. কামরুজ্জামান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘ফুটপাতের বিভিন্ন জায়গায় আমরা লোহার খুঁটি বসাচ্ছি। এটা তো চাইলেই অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধ করা সম্ভব না। তবে পর্যায়ক্রমে আমরা ট্রাফিক পূর্বাঞ্চলের সব ফুটপাতে বসাব। যাতে করে মোটরসাইকেল চাইলে ফুটপাতে তুলে দিতে না পারে। আর যারা ফুটপাতে মোটরসাইকেল তুলে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে তো আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’
ট্রাফিক পশ্চিমের উপকমিশনার আরিফুর রহমান ও ট্রাফিক দক্ষিণের উপকমিশনার দাবি করেন, এই দুই অঞ্চলের ফুটপাতে কোনো মোটরসাইকেল ওঠে না!
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন