সত্তরোর্ধ আনসার আলী চিবিয়ে চিবিয়ে পানের শেষ নির্যাসটুকু খাচ্ছিলেন। পাশের মুদি দোকানের বিদ্যুতের বাতির আলোটা তার মুখের ওপর পড়ছিল। তবে আম গাছের একটা ডাল থাকায় মুখে যেন আলো-ছায়ার ছাপ। সাদা শুভ্র দাঁড়ি। মাথার অর্ধেক চুল নেই। যা আছে সেগুলোও পাকা। ফর্সা মুখাবয়বে আলো-ছায়ার খেলার মাঝে একটা স্নিগ্ধতা খেলে যাচ্ছে।
পরিচয় দিয়ে হিজড়া প্রার্থীর বাড়ি কোথায় জানতে চাইতেই তার চোখ জোড়া আনন্দে চকচক করে উঠল। বলতে শুরু করলেন-মাইয়া খুব ভাল। অনেক বছর থেকে চিনি। একদিন বলল, মামা নির্বাচন করতে চাই। তারপর তো আমরা মুরুব্বিরাই সভা করে লোকজনকে কইলাম।
আনসার আলীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল রংপুর সিটি করপোরেশনের (রসিক) বালাপাড়ায়। এপাড়ারই ভোটার নাদিরা খানম ‘হিজড়া’। যিনি এবার রসিক নির্বাচনে ১৮, ২০ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সংরক্ষিত আসনে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
রংপুর এসেই সাধারণের কাছে জানা হয়েছিল এখানে কাউন্সিলর পদে একজন হিজড়া নির্বাচন করছেন। সেই থেকে স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছ থেকে তার মোবাইল নম্বর নিয়ে যোগাযোগ শুরু। কিন্তু তিনি জনসংযোগে মহাব্যস্ত। সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় নেই। কয়েকবার ফোন করার পরও এমনটাই বলে বারবার ফোন কেটে দিচ্ছিলেন। অবশেষে ঢাকা থেকে আসার কথা জানালে বললেন, রাত ১১টার দিকে তার বাসায় আসতে। সেই অনুযায়ী, যাওয়া হলো বালাপাড়ায়।
এ পাড়ারই স্থায়ী বাসিন্দা আনসার আলী। কাকতালীয়ভাবে তার সঙ্গে দেখা হলো। পরে জানা গেল তিনিই মূলত নাদিরা খানমের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একটা রিকশা এসে পাশে থামল।
প্রার্থীদের একটা আলাদা সাজগোজের ব্যাপার থাকে কি না জানিনা। রিকশাতে দেখেই মনে হলো তিনিই সেই কাঙ্খিত মানুষ।
নাদিরা খানম রিকশা থেকে নেমে তিনিও কী করে যেন বুঝে ফেললেন-বললেন আপনিই কী ঢাকা থেকে এসেছেন? আসেন, বলেই মূল সড়ক ঘেঁষা দেয়ালের এক কোণারছোট্ট গেটটা খুলে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
একটা উঠোন পেরুনোর পর পূর্ব-পশ্চিমমুখী লম্বা বাড়িটার একটা কক্ষে তিনি ভাড়া থাকেন। এটাই তার ঠিকানা। কথা শুরু পর অভিভূত না হয়ে পারা গেল না। কি সুন্দর উচ্চারণ, আলাপের ফাঁকে ফাঁকে দু-চারটা ইংরেজি শব্দের ব্যবহার আর তার দৃঢ় মনোবল, সত্যিই এক নির্মল আনন্দের খোরাক জোগাল। তবে তার এ অবস্থা একদিনের নয়। ঠেকে শিখতে শিখতে এ পর্যন্ত এসেছেন বলেই দাবি নাদিরার।
সেটা ১৯৯১ সনের কথা। সবে এসএসসি পাশ করেছেনম থাকতেন দিনাজপুর নিউ টাউনের বাড়িতে। আদমজী জুট মিলস’র প্রোডাকশন ম্যানেজার সিরাজুল ইসলামের চার সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বড় বোনের ততদিনে বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছোট বোনের বিয়ের কথা পাকাপাকি। হঠাৎ বরপক্ষ থেকে কথা উঠল-মেয়ের বড় বোন তো হিজড়া। তার ছোট বোন বিয়ে করায় যদি উত্তরসূরিও হিজড়া হয়! বিয়েটা তাই ভেঙেই গেল।
সিরাজুল ইসলাম চাপ দিতে থাকলেন নাদিরার মাকে। এই সন্তানের জন্য কি আরেক সন্তানের জীবন নষ্ট হবে? একে বের করে দাও। মায়ের কষ্ট দেখে নাদিরা চলে গেলেন পার্বতীপুর মামার বাড়িতে।
মামার এক বন্ধু ছিলেন নিঃসন্তান। তিনিই নাদিরাকে সন্তান হিসেবে নিলেন। দিনাজপুর আদর্শ ডিগ্রি কলেজ থেকেই তাকে বিএ (ব্যাচেলর অব আর্টস) পাশ করালেন। এরপর ইংরেজি বিষয়ে এমএ (মাস্টার্স অব আর্টস) করলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহীতেও নাদিরা ‘পালক বাবার’ সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ভাড়া বাসায় থেকে পড়াশুনা
শেষ করলেন ৯৯ সালে।
এরপর ফুলবাড়ীয়া চলে এসে ছোটখাট কিছু ব্যবসা শুরু করেন। ২০০৬-০৭ সালের দিকে পরিচয় হয় রংপুরের নূরজাহান হিজড়ার সঙ্গে। তার পরামর্শেই রংপুর চলে আসেন। হিজড়াদের উন্নয়নে দাঁড় করান-ন্যায় অধিকার তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থা।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিদের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে তিনি এখন ৩৭০ জন হিজড়ার উন্নয়নে কাজ করছেন। তাদের নিয়ে কাজ করতে করতেই সমাজের মূল ধারায় কাজ করার তাগিদ অনুভব করেন তিনি। সেই থেকেই তার চিন্তা হলো জনপ্রতিনিধি হওয়ার। আর এ চিন্তা থেকেই সংরক্ষিত আসনের প্রার্থী হলেন।
নাদিরা খানম বলেন-‘আমার মতো যারা হত দরিদ্র লোক আছেন, তারা বাস্তবের সঙ্গে যুদ্ধ, সংগ্রাম করছেন। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে তাদের জীবন চালাতে হচ্ছে। এ সমস্ত লোকদের যেন সেবা করতে পারি। হিজড়ারাও কিছু কাজ করতে পারে এবং সমাজে তাদেরও কিছু কন্ট্রিবিউশন আছে, এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা। ইনশাল্লাহ আরেকটু চেষ্টা করলে জয় নিশ্চিত হবে।’
আগামী ২১ ডিসেম্বর রসিক নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে। নাদিরা পাঁচ জনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
দেশের সিটি নির্বাচনে হিজড়া হিসেবে নাদিরাই প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর আগে যশোরের বাঘারপাড়া পৌরসভা এবং সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভাতেও সংরক্ষিত নারী আসনে দুই হিজড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
বাংলানিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন