গ্যাসের কোনো সংকট নেই। কিন্তু নতুন সংযোগ দেয়ার অনুমতি নেই সরকারের। তাই গ্রাহকের ১১ হাজার আবেদনপত্রের পাহাড় পড়ে আছে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (পিজিসিএল) দপ্তরে। দিনে দিনে সেসব আবেদনে ধুলা জমেছে, পোকায় খাচ্ছে সেসব। কিন্তু গ্রাহকরা গ্যাস পাবেন কবে, তার উত্তর নেই পিজিসিএলের কাছে।
সরকারি এই সংস্থার তথ্য, রাজশাহীর ১১ হাজার আবেদনের মধ্যে প্রায় ৫৫০ জন গ্রাহকের নামে ডিমান্ড নোট ইস্যু হয়ে আছে। সরকারি নির্দেশনা না থাকায় তাদের গ্যাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দুই বছরের বেশি সময় ধরে গ্যাস না পেয়ে গ্রাহকদের কেউ কেউ জমা দেওয়া টাকা ফেরত নিতে শুরু করেছে।
বিষয়টি স্বীকার করে পিজিসিএলের রাজশাহীর কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি পাঁচ-ছয়জন গ্রাহক তাদের জমা দেওয়া টাকা ফেরত নিয়েছেন। আরও কেউ চাইলে তাদেরও ফেরত দেওয়া হবে।
এসব গ্রাহকের ক্ষোভের কথা উল্লেখ করে কর্মকর্তারা জানান, ডিমান্ড নোট ইস্যু হওয়া গ্রাহকরা ন্যূনতম ৬ হাজার ৩০০ থেকে ৫০-৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। বাসাবাড়ির ওয়ারিংও করেছেন তারা। কিন্তু গ্যাস পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় তারা টাকা ফেরত নিচ্ছেন।
নগরীর সাগরপাড়া এলাকার বাসিন্দা মহাররম আলী। গ্যাস সংযোগ দেওয়া শুরু হলে তিনি আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তার নামে ডিমান্ড নোটই ইস্যু হয়নি। সম্প্রতি তিনি গ্যাস সংযোগের খোঁজখবর নিতে পিজিসিএলে গিয়েছিলেন। কর্মকর্তারা তাকে বলেছেন, তার মতো আরও ১১ হাজার গ্রাহকের আবেদন পড়ে আছে। চাইলে তিনি আবেদনের টাকা ফেরত নিতে পারেন।
একই এলাকার বাসিন্দা জুলফিকার রহমানের ক্ষোভ আরেকটু বেশি। তিনি জানান, তার নামে ডিমান্ড নোট ইস্যু হওয়ার পর তিনি মূল লাইন থেকে বাসা পর্যন্ত পাইপ বসিয়েছেন। বাড়ি ওয়ারিং করেছেন, চুলো বসিয়েছেন। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু গ্যাস পাননি। এখন গ্যাস নেই বলে তার তিনতলা বাড়িতে ভাড়াটিয়া আসছেন না।
বাসাবাড়িতে গ্যাসের জন্য আন্দোলন কম করেনি রাজশাহীর মানুষ। এ দাবিতে হরতালও পালন করা হয়েছে। এরপর গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সপ্তাহ খানেক আগে তড়িঘড়ি করে রাজশাহীতে গ্যাসের পাইপলাইন স্থাপন করা হয়। ব্যয় করা হয় ১০৮ কোটি টাকা। এরপর ৯ হাজার ১৫৫টি বাসাবাড়িতে গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হয়। ৮টি কারখানা ও একটি সিএনজি স্টেশনও গ্যাস পায়।
বছর দুয়েক দেয়া হয় গ্যাস সংযোগ। এরপর জারি হয় সরকারের নিষেধাজ্ঞা। এতে আটকে যায় ডিমান্ড নোট ইস্যু হওয়া ৫৫০ জন গ্রাহকের গ্যাস সংযোগ। আবেদন পড়ে আছে আরও ১১ হাজার গ্রাহকের। এ ছাড়া পিজিসিএলে পড়ে আছে ৩০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আবেদন। তবে ৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানায় পিজিসিএল।
রাজশাহী শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি মনিরুজ্জামান মনি বলেন, রাজশাহীর শিল্পকারখানায় গ্যাস-সংযোগ না দিলে উত্তরাঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে না। অথচ রাজশাহীতে নামমাত্র কয়েকটি কারখানায় গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সেটাও বিশেষ বিবেচনায়। আবেদন করা সব শিল্প-কারখানায় দ্রুত গ্যাস সংযোগের দাবি জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।
পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস-সংযোগ দেয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেছে রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সামাজিক সংগঠন। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘গত সিটি নির্বাচনের আগে গ্যাসের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের ভোট নেওয়া হয়েছিল। কিছুদিন পর আসছে সিটি নির্বাচন। এ নির্বাচনে এর জবাব চাইব।’ অচিরেই গ্যাস সংযোগ দেওয়া শুরু না হলে আন্দোলনের হুমকি দেন তিনি।
রাজশাহীতে গ্যাসের জন্য ২০০৪ সাল থেকে ‘গ্যাস আন্দোলন পরিষদ’ নামের আরেকটি সংগঠন আন্দোলন করে। লক্ষাধিক মানুষের গণস্বাক্ষর-সংবলিত ৮৬ কেজি ওজনের স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়। সে সময় গ্যাসের দাবিতে রাজশাহীতে হরতালও পালিত হয়। মানববন্ধন হয় প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। এরপর গত সিটি নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে রাজশাহীতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়।
ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন পরাজিত হন বিএনপির প্রার্থীর কাছে। মেয়র হন মহানগর বিএনপির সভাপতি মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। তার অভিযোগ, তিনি মেয়র হওয়ার পর রাজনৈতিক কারণে সরকার গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়।
তবে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুজ্জামান লিটনের কথা, শুধু রাজশাহী নয়, সারা দেশেই গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ রয়েছে।
লিটন বলেন, তিনি যদি নির্বাচিত হতেন তাহলে যেকোনো মূল্যে গ্যাস সংযোগের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতেন। এবার নির্বাচনী ইশতেহারে গ্যাস এক নম্বর বিষয় থাকবে জানিয়ে লিটন বলেন, ‘এ নিয়ে আন্দোলন করার প্রয়োজন নেই। মেয়র নির্বাচিত হলে আবেদনকারীদের বাড়িতে গ্যাস পৌঁছে দেওয়াসহ রাজশাহীতে গ্যাসনির্ভর রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেব।’
জানতে চাইলে পিজিসিএলের জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং) প্রকৌশলী কামরুজ্জামান খান বলেন, সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় রাজশাহীতে বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি নির্দেশনা পেলেই গ্যাস সংযোগ দেওয়া শুরু হবে। গ্রাহকদের এখন অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার নেই।
(ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন