ফুটপাতের চায়ের দোকানি ফরহাদ হোসেন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। তাঁর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে কোপানো হয়েছে। মাথা ও হাতে সেলাই পড়েছে ১৭টি। রড দিয়ে পিটিয়ে কোমর থেকে দুই পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এসবই হয়েছে ফরহাদের ‘নিজের দোষে’। তাঁর ‘দোষ’ হলো তিনি মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। তাঁকে এখন রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
সুস্থ-সবল ছেলের এই করুণ পরিণতি দেখে মা-বাবা অনেকটা নির্বাক হয়ে পড়েছেন। ছেলেকে নিয়ে চরম অসহায়ত্বের মধ্যে আছেন তাঁরা। সন্ত্রাসীদের ভয়ে মামলা করতেও যেতে পারেননি। এই অসহায় বাবা মো. ইউনুস কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘শুধু মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে কথা বলায় আমার নিরপরাধ ছেলেকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছে সন্ত্রাসীরা। বাঁচানোর চেষ্টা করছি।’
জানতে চাইলে খিলগাঁও থানার ওসি মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের একটি ঘটনার তথ্য পেয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। ফরহাদের পরিবার মামলা করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সবুজবাগ ওহাব কলোনি, খিলগাঁও, বাসাবো, রামপুরা, মুগদার টিটিপাড়া এলাকায় সন্ধ্যার পর রীতিমতো মাদকের হাট বসে। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা ইয়াবার পাশাপাশি ফেনসিডিলও কিনছে। আবার যাদের টাকার দাপট বেশি তারা হেরোইন কিনছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয়ে পুলিশের সোর্সরা এসব মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে। মাদকের প্রভাবে এলাকার অনেক পরিবার এখন বিপর্যস্ত। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আতঙ্কে আছেন অভিভাবকরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এসব এলাকায় মাদকচক্রের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অর্ধশতাধিক পেশাদার সন্ত্রাসী। তাদের মধ্যে কিলার তারেক, সজল ওরফে কাইলা সজল, বড় জাহিদ ওরফে পাগলা জাহিদ, সাইফুল ওরফে ভোঁতা সাইফুল অন্যতম। কাউকে হত্যা, গুম ও মারধরের প্রয়োজন হলে মাদক কারবারিরা তাদের ব্যবহার করে। এই চক্রের সদস্যরাই গত ১১ জানুয়ারি রাতে চা বিক্রেতা ফরহাদ হোসেনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা চালায়। এর আগে এই চক্রের সদস্যরা খিলগাঁও মডেল কলেজের ছাত্র নুরুজ্জামানকে মারধর করে। ভুক্তভোগীর দাবি, মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে মারধর করা হয়।
ফরহাদের বাবা মো. ইউনুস অভিযোগ করে বলেন, ‘হামলাকারীরা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ। আমাকে ফোন করে থানায় যেতে নিষেধ করেছে। থানায় গেলে আমার অবস্থাও ছেলের মতো হবে বলে হুমকি দিয়েছে। হামলাকারীরা থানায় প্রভাব খাটিয়ে উল্টা আমার ছেলেকে আসামি করে মামলা দিয়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অভিভাবক কালের কণ্ঠকে জানান, অনেকটা প্রকাশ্যেই বিভিন্ন ধরনের মাদক পাওয়া যায়। থানায় অভিযোগ করা হলে মাদক কারবারিরা জেনে যায়। তা ছাড়া পুলিশের সোর্সরাও এ কারবারের সঙ্গে জড়িত। তাদের সঙ্গে সখ্য রয়েছে মাদক সন্ত্রাসী ও কয়েকজন রাজনীতিকের।
ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্র বলছে, নগরীর আটটি অপরাধ বিভাগের মধ্যে মতিঝিল বিভাগের ওহাব কলোনি, খিলগাঁও তিলপাপাড়া, টিটিপাড়া বস্তি, রামপুরা ও বাসাবো এলাকায় মাদকের আগ্রাসন বেশি। এখানে মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করা হলেও খুব একটা সুফল মেলেনি।
যোগাযোগ করা হলে মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডিএমপিতে বর্তমানে মাদকের উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এই এলাকাগুলো। মাদকের প্রভাব এখনো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। তবে মাদক শুধু এই এলাকারই সমস্যা নয়, প্রতিটি এলাকায় মাদক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আমরা যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। বিশেষ করে মাদকের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের খোঁজ চলছে। রুট খোঁজা হচ্ছে।’
খিলগাঁওয়ে চার ভাইয়ের রাজত্ব : সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, খিলগাঁও তিলপাপাড়ার ১৭ নম্বর গলির একটি বহুতল ভবন ও ওহাব কলোনি ঘিরে একটি সংঘবদ্ধ মাদকচক্র গড়ে উঠেছে। ওই বহুতল ভবনের মালিক একজন নারী। তিনি এরই মধ্যে পরলোকগমন করেছেন। তাঁর চার ছেলে মোহাম্মদ আবুল ওরফে মাদক আবুল, সাইফুল ওরফে খোকন, বাবু ওরফে ফেন্সি বাবু ও শেখ মামুন ওরফে ইয়াবা মামুন ওই এলাকার মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে। চার ভাইয়ের আলাদা সিন্ডিকেট রয়েছে। এসব সিন্ডিকেটে ২০ থেকে ৫০ জন করে মাঠকর্মী আছে। সন্ধ্যা হলেই ওই ভবনকে কেন্দ্র করে এলাকায় প্রকাশ্যে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক বিক্রি হয়। ক্রেতাদের মধ্যে বিভিন্ন বয়সী উঠতি তরুণ-তরুণী, কিশোর ও যুবক রয়েছে। সংঘবদ্ধ এই মাদকের কারবারে পুলিশের কয়েকজন সোর্সও আছে। চার ভাইয়ের মধ্যে আবুল স্থানীয় লোকজনের কাছে ‘মাদক গডফাদার’ হিসেবে পরিচিত। তাঁর ছেলে শাওনও পূর্বপুরুষদের মতোই মাদকের কারবারে জড়িত।
ওহাব কলোনিতে চিহ্নিতরাই কারবারি : স্থানীয় সূত্র জানায়, ওহাব কলোনিতে মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে দিপু ওরফে ডাকাত দিপু, জামাই মামুন ওরফে মামুন। এই মামুন একসময়ের মাদক সম্রাজ্ঞী মাফি ওরফে ইয়াবা মাফির ছোট মেয়ের জামাই। মাফি দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। মাদক কারবারের বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষ তাঁকে হত্যা করেছে বলে স্থানীয় লোকজন ধারণা করছে। দিপু ওরফে ডাকাত দিপুকে এর আগে একাধিকবার আটক করে র্যাব ও পুলিশ। তবে প্রতিবারই জামিনে বেরিয়ে এলাকায় ফের মাদকের কারবার চালান। মামুনও এর আগে গ্রেপ্তার হন। বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। এই চক্রের সদস্য রমজান ওরফে ভাস্তা রমজান, জসিম, জাহিদ ওরফে ভাগ্নে জাহিদ, সৌরভ, সালাউদ্দিন, আরমান ও আরমানের স্ত্রী তানিয়া, চম্পা রানীসহ আরো অন্তত ২০ জন। এই মাদক কারবারিদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে বিপ্লব নামে একজনের নাম পাওয়া গেছে। এই চক্রের হোতারা এলাকায় ‘দেহরক্ষী’ নিয়ে চলাফেরা করে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন