অপেক্ষা আর কয়েক মুহূর্তের। এরপরই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানতে লাখো মানুষের ঢল নামবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। একুশের প্রথম প্রহরে শুরু হবে ভাষা শহীদদের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন। ফুলে ফুলে ভরে যাবে শহীদ মিনারের বেদি।
দিবসটিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর সবচেয়ে বড় ফুলের বাজার শাহবাগে চলছে ফুল বিক্রির ধুম। শাহবাগ ফুল মার্কেটের স্থায়ী দোকানগুলোর পাশাপাশি নারী শিশুদেরও রাস্তায় ফুল বিক্রি করতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে চাঙা রাজধানীর অন্যতম ফুলের এ বাজার। শাহবাগের মূল দোকানগুলো ছাড়িয়ে শাহবাগ থানার গেট থেকে শিশু-পার্কের সামনে পর্যন্ত বসেছে ফুলের দোকান। দোকানগুলোর পাশাপাশি রাস্তায় বসেও ফুলের ডালা, তোড়া বানানোর কাজ করছেন কারিগররা। সব মিলেয়ে শাহবাগ এখন ফুলময়।
নানা ধরনের ফুলের সমারোহে সেজেছে শাহবাগ। একুশের জন্য ফুল কিনতে আসা ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়ে হিমশিম খাচ্ছেন বিক্রেতারাও। ক্রেতাদের কেউ কেউ বানিয়ে নিচ্ছেন ফুলের ডালা, তোড়া কেউবা কিনছেন ফুল।
ফুল সজ্জা নামক দোকানের বিক্রেতা জাকারিয়া জানান, ব্যক্তিগত ক্রেতার তুলনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কোম্পানির লোকজন বেশি ফুল কিনছেন। তারা শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে ফুলের ডালা নিয়ে যাচ্ছেন আবার অনেকে অর্ডার দিচ্ছেন সকালের জন্য। সে অনুযায়ী কারিগররা ব্যস্ত ফুলের ডালা, তোড়া তৈরিতে। মূলত বিক্রি শুরু হবে সন্ধ্যার পর। রাত ১২টার মধ্যেই অধিকাংশ ফুল বিক্রি হয়ে যাবে। আগামীকাল সকালেও কিছু ফুল বিক্রি হবে।
প্রতিটি ফুলের দোকানে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। ফুল, বাঁশের চাটাই আর শোলায় তৈরি হচ্ছে ছোট, বড় ও মাঝারি আকারের তোড়া। ফুলের তোড়া তৈরির কাজ করছিলেন হাসিবুর রহমান নামের এক কর্মী। তিনি বলেন, শহীদ মিনারের কাছে শাহবাগের ফুলের দোকান হওয়ায় বিক্রির চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। প্রতি বছরের এ সময়ে দোকানদাররা পুরো বছরের ব্যবসা করেন। সে কারণে কাজের চাপও বেশি। সকাল থেকে টানা তোড়ার কাজ করছি, এত কাজের চাপ যে খাওয়ার সময়ও পাইনি।
তিনি আরও বলেন, ডিজাইন ও আকার ভেদে ৩০০ থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে ফুলের তোড়া বা ডালা বিক্রি হচ্ছে।
ফুলের তোড়া কিনতে এসেছেন একটি সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি দল। তাদের মধ্যে একজন দিলরুবা আক্তার। তিনি বলেন, ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে যাবো, সে লক্ষ্যেই ফুলের তোড়া কিনতে আসা। কিন্তু এখানে এত্ত ফুল তবুও ফুল পাওয়া যাচ্ছে না। দোকানিরা বলছেন আগেই সবাই অর্ডার দিয়ে গেছে। এ ছাড়া যে দোকানগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে তারাও দাম চাচ্ছেন অতিরিক্ত। এরই মধ্যে দরদাম করে ৭০০ টাকায় একটা তোড়া কিনেছি।
প্রস্তুত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
এদিকে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে শহীদ মিনার কর্তৃপক্ষ।
শহীদ মিনারের সামনে রাস্তার পাশের দেয়ালে রঙের সমারহ। তাতে আঁকা হয়েছে বিভিন্ন লোকজ আল্পনা। তার ওপরে লেখা হচ্ছে একুশের কবিতা, গানের পঙিক্ত, বিখ্যাত মানুষদের উক্তি। শহীদ মিনারের বিভিন্ন স্থান ধোয়ামোছায় ব্যস্ত ছিলেন কিছু মানুষ। মূল বেদিসহ কয়েকটি স্থানে রঙের কাজ শেষ হয়েছে। চারদিকে বাঁশের বেষ্টনী। বাঁশ মোড়ানো হয়েছে সাদা কাপড়ে। আশপাশের গাছগুলোর নিচের অংশে সাদা রং লাগানো হয়েছে।
শহীদ মিনার এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে র্যাব ও পুলিশের একাধিক ওয়াচ টাওয়ার। পুরো এলাকায় টহল দিচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
এ বছরও যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি পালনের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের উদ্দেশ্যে একটি ‘কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি’ এবং বিভিন্ন সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি দিবসটি সুষ্ঠুভাবে পালনে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। একুশের প্রথম প্রহরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিমূল প্রস্তুত করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় দেখা যায়, রং আর আলপনার কাজ শেষে চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে রাখা শহীদ মিনারে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না কাউকেই। চলছে শেষ সময়ের ঝাড়ু, ধোয়া-মোছা ও রংয়ের কাজ।
আলপনার কাজ শেষ হয়েছে আগেই। ধোয়া মোছার কাজে নিয়োজিত আছেন প্রায় ১২-১৫ জনের একটি দল। এদের মধ্যে সাব্বির আহমেদ নামের একজন বলেন, এখন শহীদ মিনারের বেদিসহ পুরোটাই ধোয়ার কাজ করছি।
পরিচ্ছন্নতায় কর্মরত মফিজুর রহমান বলেন, আগেই সব কাজ শেষ হয়েছে এখন কয়েকজন রয়েছেন যারা রাত পর্যন্ত কিছুক্ষণ পরপর ঝাড়ু দেয়ার কাজ করবেন। আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন, শহীদ মিনার এখন শ্রদ্ধা জানাতে প্রস্তুত।
অপরদিকে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও আজিমপুর কবরস্থানে জনসাধারণের যাতায়াতে বিকল্প পথ ব্যবহারের আহ্বান জানানো হয়েছে।
শহীদ মিনারে যাতায়াতের রুট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘একুশে উদযাপন কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি’ এ আহ্বান জানায়। কমিটি আজিমপুর কবরস্থান ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাতায়াতের জন্য একটি রুট প্রণয়ন করেছে। রুট-ম্যাপটি ২০ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে কার্যকর হবে।
রুট-ম্যাপ অনুযায়ী জনসাধারণ পুরনো হাইকোর্টের সামনের রাস্তা দিয়ে দোয়েল ক্রসিং, বাংলা একাডেমি, টিএসসি মোড়, উপাচার্য ভবনের পাশ দিয়ে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি মোড়, নিউমার্কেট-ক্রসিং পার হয়ে আজিমপুর কবরস্থানের উত্তর দিকের গেট দিয়ে কবরস্থানে প্রবেশ করবেন এবং শহীদদের কবর জিয়ারতের পর আজিমপুর কবরস্থানের মূল গেট (দক্ষিণ দিকের) দিয়ে বের হয়ে আজিমপুর সড়ক হয়ে পলাশী মোড় ও ফুলার রোড মোড় হয়ে অর্থাৎ সলিমুল্লাহ হল ও জগন্নাথ হলের সামনে দিয়ে শহীদ মিনারে যাবেন।
কবরস্থানে না গিয়ে বিকল্প পথে যারা শহীদ মিনারে যেতে চান তারা উপাচার্য ভবন পার হয়ে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি মোড় থেকে বাম দিকের রাস্তা দিয়ে (জহুরুল হক হলের পশ্চিমের রাস্তা) সলিমুল্লাহ হল ও জগন্নাথ হলের সামনের রাস্তা হয়ে শহীদ মিনারে যেতে পারবেন।
নিউমার্কেট ক্রসিং থেকে হোম ইকোনমিক্স ও ইডেন কলেজের সামনের রাস্তা দিয়েও আজিমপুর (বেবি আইসক্রিম) মোড়, পলাশী মোড় হয়ে সলিমুল্লাহ হল ও জগন্নাথ হলের সামনের রাস্তা হয়ে শহীদ মিনারে যাওয়া যাবে।
চাঁনখারপুল এলাকা থেকে বক্শীবাজার মোড় হয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশের রাস্তা দিয়েও পলাশী মোড় হয়ে সলিমুল্লাহ হল ও জগন্নাথ হলের সামনের রাস্তা দিয়ে শহীদ মিনারে যাওয়া যাবে।
টিএসসি মোড় থেকে জগন্নাথ হলের পূর্ব পাশের রাস্তা অর্থাৎ শিব বাড়ির পশ্চিম পাশ দিয়ে শহীদ মিনারে ও মেডিকেল কলেজে যাওয়ার রাস্তা সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে। উপাচার্য ভবন গেট থেকে ফুলার রোড হয়ে ফুলার রোড মোড় পর্যন্ত রাস্তা এবং চাঁনখার পুল থেকে কার্জন হল পর্যন্ত রাস্তা জনসাধারণের যাতায়াতের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পর সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের সামনের রাস্তা দিয়ে দোয়েল চত্বর ও পেছনের রাস্তা দিয়ে চাঁনখারপুল হয়ে শুধুমাত্র প্রস্থান করা যাবে, শহীদ মিনারের দিকে আসা যাবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন