আমনের উৎপাদন কিছুটা কম হলেও দেশে চালের ঘাটতি নেই একটি সিন্ডিকেট নানা অপকৌশলে সরবরাহ কমিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে অথচ এই সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার অতি ব্যবসায়ীবান্ধব দুই মন্ত্রীকে দুষছেন কেউ কেউ
বাজার মূল্যের চেয়ে সরকারের বেঁধে দেয়া দর বেশখানিকটা কম হওয়ায় বোরোর মতো এবার আমন সংগ্রহ অভিযানও ব্যর্থ হয়েছে। তাই চাতাল ও মিলমালিকদের গুদামে পর্যাপ্ত ধান-চাল থাকলেও সরকারের ঘর অনেকটাই ফাঁকা। এ অবস্থায় চালের আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে। যা এখন চালের দরের পাগলা ঘোড়াকে লাগামছাড়া করেছে।
বাজার সংশিস্নষ্টরা জানান, বর্তমানে পুরনো মৌসুমের চালের মজুদ কমে আসছে। ২০১৭ সালে বাজারে অস্থিরতার পর থেকে দেশের চালের বাজার আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। বর্তমানে ৬০-৭০ শতাংশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে আমদানিকৃত চাল। ফলে প্রতিদিনই পাইকারি বাজারে দামের ওঠানামা রয়েছে।
তাদের ভাষ্য, ভারত থেকে চাল আমদানিতে আগের চেয়ে টনপ্রতি ২৫-৪০ ডলার বেশি ব্যয় হচ্ছে। ঊর্ধ্বগতির একই দশা থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়াসহ চাল রপ্তানিকারক অন্যান্য দেশেও। তাই বাড়তি মূল্যে আমদানি করা এ চাল স্থানীয় বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আর এ সুযোগে চাতাল ও মিলমালিকদের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে চালের দর ঊর্ধ্বমুখী করে তুলছে।
চাল আমদানিকারকরাও অনেকটা একই সুরে জানান, দেশে বর্তমানে চালের কোনো সংকট নেই। ভারত থেকেও পর্যাপ্ত চাল আমদানি হচ্ছে। তবে বর্তমানে ভারত সরকার চাল সংগ্রহ করায় সে দেশে দাম কিছুটা বেড়েছে। আমদানিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে দেশের বাজারেও। ভারতে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বড় মিলমালিকরাও সরবরাহ সীমিত করে এনেছেন। দু-একদিনের মধ্যে দাম বাড়িয়ে তারা সরবরাহ স্বাভাবিক করবেন- এমনটাই অনুমান করেন তারা।
তবে এ অভিযোগ ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্ত্মিমূলক বলে দাবি করেন মিল মালিকরা। বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানান, ধান সংকটের কারণে মিল থেকে চালের সরবরাহ কমেছে। এমনকি ধানের অভাবে অনেক মিল বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া বাজারে ধানের দাম বেড়েছে। ভারত থেকে আমদানি মূল্যও বেড়েছে। এ কারণে চালের বাজার বাড়তির দিকে রয়েছে।
যদিও কৃষক ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানান, দেশের বড় বড় চাতাল ও মিলমালিকদের গুদামে প্রচুর ধান রয়েছে। যা তারা তাদের ঘোষিত-অঘোষিত বিভিন্ন গুদামে মজুদ করে রেখেছেন। অটো রাইস মিলগুলোতে প্রতিদিনই হাজার হাজার টন ধান ভাঙানো হচ্ছে। তবে এর সামান্য অংশ তারা বাজারে ছাড়ছে। খাদ্য অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে চাতাল ও মিলমালিকদের আঁতাত থাকায় তারা এসব তথ্য গোপন রাখছেন। আর এ কারণেই চালের আমদানিনির্ভরতা বাড়ার পাশাপাশি এর দরও বেড়েছে- এমনটাই দাবি তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ডিসি ফুড) যায়যায়দিনকে বলেন, এবার আমনের উৎপাদন কিছুটা কম হলেও দেশে চালের ঘাটতি হওয়ার মতো কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি। তবে বাজার সিন্ডিকেট নানা অপকৌশলে সরবরাহ কমিয়ে এনে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। আর এ কারণেই আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে। চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে আমদানি না বাড়িয়ে বরং বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে সরকার তৎপর হলে এ সংকট দ্রম্নত কাটতো বলে মনে করেন ওই খাদ্য কর্মকর্তা।
রপ্তানিকারক দেশগুলো চালের দাম আরও বাড়ালে দেশের বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব আরও খারাপভাবে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। তারা জানান, নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের আমদানিনির্ভরতা শুধু দামই বাড়ায় না, এর বাজারও যে কোনো সময় অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা জরম্নরি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের মধ্য ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত্ম সরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৭৫ হাজার টন। এর মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি করা হয়েছে ২১ লাখ ৪৫ হাজার টন যার সিংহভাগই এসেছে ভারত থেকে। এ চালের বড় অংশই ব্যবসায়ীরা এনেছেন দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে। আমদানির এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে এক সপ্তাহ আগের তুলনায় ৩০/৩৫ ডলার অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হচ্ছে।
চাল আমদানিকারকরা জানান, এক সপ্তাহ আগেও ভারত থেকে মানভেদে প্রতি টন স্বর্ণ চাল আমদানি হতো ৪২৫-৪৩৫ ডলারে। একই চাল আমদানিতে এখন ব্যয় হচ্ছে ৪৫০-৪৫৫ ডলার। একইভাবে রত্না জাতের চালেও টনপ্রতি সর্বোচ্চ ৩০ ডলার বেশি খরচ হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে স্থলবন্দরটি দিয়ে প্রতি টন ভারতীয় রত্না চাল ৪৪০-৪৫০ ডলার মূল্যে আমদানি হলেও এখন ব্যয় করতে হচ্ছে ৪৭০ ডলার।
বাড়তি দামে আমদানি করা প্রতি কেজি স্বর্ণা চাল ৩৮ থেকে সাড়ে ৩৮ টাকায় বিক্রি করছেন আমদানিকারকরা। একই চাল এক সপ্তাহ আগে তারা বিক্রি করেছিলেন কেজিপ্রতি সাড়ে ৩৬-৩৭ টাকা দরে। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি রত্না চাল ৩৯ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪২ টাকা।
পাইকারি বিক্রেতারা জানান, ভারতে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারেও বাড়ছে। আমদানিকারকদের কাছ থেকে তাদের বেশি দামে পণ্যটি কিনতে হচ্ছে। তাই তারাও বেশি দামে চাল বিক্রি করছে।
ভারতে চালের মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছেন স্থানীয় মিলাররাও। ফলে কয়েক দিনের ব্যবধানে রাজধানীতেও সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। রাজধানীর পাইকারি বাজারে পণ্যটির দাম কেজিতে ১ টাকা বাড়লেও খুচরায় বেড়েছে আড়াই থেকে তিন টাকা।
রাজধানীর বাদামতলি চালের আড়ত ঘুরে বুধবার পাইকারিতে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৫৮-৫৯ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। অথচ কদিন আগেও এ বাজারে এ চাল বিক্রি হয়েছে ৫৬-৫৭ টাকায়।
এদিকে চট্টগ্রামেও সব ধরনের চালের দাম বাড়তির দিকে রয়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে সর্বোচ্চ ২ টাকা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বেশি দামে চাল কেনার কারণে এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও।
বন্দরনগরীর স্থানীয় আড়তদাররা জানান, এক সপ্তাহ আগেও প্রতি বস্ত্মা (৫০ কেজি) ভারতীয় বেতি চাল বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৭৫০ টাকায়। একই চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৯০০ টাকায়। মিয়ানমার থেকে আমদানি করা একই পরিমাণ চাল ১ হাজার ৫৫০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আমদানিকৃত চালের পাশাপাশি দেশি চালের দাম বাড়ার কথাও তারা স্বীকার করেছেন। তারা জানান, খাতুনগঞ্জে ৫০ কেজির প্রতি বস্ত্মা মিনিকেট চাল ২ হাজার ৪০০ থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। এছাড়া প্রতি বস্ত্মা পাইজাম ২ হাজার ৩০০ থেকে বেড়ে ২ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব চালের দাম খুচরা পর্যায়ে আরেক দফা বেড়ে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি চাল বাবদ ভোক্তাদের অতিরিক্ত আড়াই থেকে তিন টাকা বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে।
এদিকে দেশে পর্যাপ্ত চাল মজুদ এবং বিভিন্ন দেশ থেকে যথেষ্ট চাল আমদানির পরও ফের এ বাজারে উত্তাপ বাড়ার জন্য কেউ কেউ সরকারের দুর্বল নজরদারি ও অপরিপক্ব পরিকল্পনাকে দায়ী করছেন। ক্রেতা অধিকার সংরক্ষণ সংস্থা ক্যাব চালের দর বৃদ্ধির নেপথ্যে ব্যবসায়ীদের কারসাজি উলেস্নখ করে সরকারের দুই মন্ত্রীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্যকে উস্কানি হিসেবে দায়ী করেছে। ক্যাব বলছে ক্রেতা অধিকার উপেক্ষা করে দুই মন্ত্রী চালবাজ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করছেন।
ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজির হুসাইন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরম্নল ইসলামকে 'অতি ব্যবসায়ীবান্ধব' আখ্যায়িত করে বলেন, চাল নিয়ে দুই মন্ত্রীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্যই দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী। তারা জনগণের স্বার্থে কথা না বলে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বেশি দেখছেন। যার নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ছে। কারসাজিতে জড়িত মিল মালিকদের পক্ষ নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এটা চালের দাম বাড়াতে উসকে দেয়ার শামিল বলে মন্ত্মব্য করেন তিনি।
ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেস্ট নাজির হুসাইন অভিযোগের সুরে বলেন, সরকার কখনো কৃষকের কাছ থেকে চাল কেনে না। মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল কেনে। তারা সরকারের দুর্বলতার সুযোগে নানা অজুহাতে চালের দাম বাড়ায়। বর্তমানে চালের মজুদ যথেষ্ট থাকলেও সরকারি পর্যায়ে মজুদকৃত চাল সরবারহে ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে। সঠিকভাবে এই চাল সরবরাহ করা হলে চালের দাম আরও না বেড়ে বরং কমতো।
এদিকে বিদেশ থেকে চাল আমদানির বিষয়ে দায়িত্বশীল দুই মন্ত্রীর দুই ধরনের তথ্য এ বাজারের ভিত দুর্বল করে তুলেছে বলে অভিযোগ করেন বাজার পর্যবেক্ষকরা অনেকেই। তাদের ভাষ্য, এ বিষয়ে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার কথা এবং মন্ত্রীরা এর উপর ভিত্তি করে কথা বলবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে তার পুরোটাই উল্টো হয়েছে। যা বাজারসিন্ডিকেটের বিশেষ সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চাল আমদানি নিয়ে জাতীয় সংসদে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং খাদ্যমন্ত্রী কামরম্নল ইসলাম। বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, গত ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত্ম চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২২ লাখ ৩৮ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। অন্যদিকে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, চলতি অর্থবছরে ১৫ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে আট লাখ টন দেশের বন্দরে এসে পৌঁছেছে। দেশে বর্তমানে খাদ্য ঘাটতি নেই বলেও খাদ্যমন্ত্রী দাবি করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন