দেশের জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পাঠাও নিয়ে যন্ত্রণা ও ভোগান্তিতে পড়েছে অনেকে। শুরু থেকে প্রতিষ্ঠানটির ত্রুটিপূর্ণ ম্যাপ ও জিপিএস সিস্টেম ভোগান্তিতে ছিল গ্রাহকেরা। সে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে, ফিলিং স্টেশন ও সিএনজি স্টেশন এবং লোকসমাগম বেশি হয় এমন স্থানে পাঠাও প্রতিনিধিদের উৎপাত। এ ছাড়া নারীরাও হচ্ছেন প্রতিনিয়ত বিশেষ ভোগান্তির স্বীকার। সব মিলে পাঠাও হয়ে উঠেছে বাইকারদের এক বিশেষ যন্ত্রণার নাম।
বেশ কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে পাঠাও সার্ভিসে জড়িত বাইকারদের খারাপ ব্যবহার, অ্যাপে না গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে যাবার অফার, যাত্রা শুরুর আগেই অ্যাপ রাইড চালু করা এবং নারীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার। এ ছাড়াও অনিয়ন্ত্রিত ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর অভিযোগ বরাবরের মতই এখনো রয়েছে। অভিযোগ নিয়ে কল সেন্টার ফোন করেও কোনো লাভ হয় না; কারণ কল সেন্টারের প্রতি অভিযোগ সবচাইতে পুরনো।
যন্ত্রণার অপর নাম পাঠাও
ফাইল ছবি
২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পাঠাও। অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পাঠাও-এর সেবা নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ ছিল শুরু থেকেই। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে প্রো ডিসকাউন্ট নিয়েও চলছে লুকোচুরি খেলা। যারা বেশি ব্যবহার করে অনেক সময় তাদের অফারগুলো দেয়া হয় না। যারা পাঠাও ব্যবহার শুরু করেছে এবং কম করে তাদের বেছে বেছে অফার দেয়া হয়। প্রো কোডগুলোও ব্যবহার হয় না অনেক সময়। ডেলিডেটি বা অন্য সমস্যার কারণে কোডগুলো ব্যবহার করা যায় না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া নতুন সার্ভিস পাঠাও ফুড নিয়েও গ্রাহকরা সন্তুষ্ট নয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নিকুঞ্জ’র একটি সিএনজি ও ফিলিং স্টেশন দাঁড়িয়ে থাকা পাঠাও প্রতিনিধি পাঠাও-তে নাম লেখানোর জন্য প্রতিটি মোটরবাইক, প্রাইভেট কারগুলোর কাছে গিয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করছিল। ফিলিং স্টেশন থেকে এ সময় বের হয়ে আসা বেশ কয়েকজন বাইকার ও কার ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিষয়টি নিয়ে তারা বেশ বিরক্ত এবং অপমানিত বোধ করছে। অনেকের সঙ্গে তর্ক করতেও দেখা যায় পাঠাও প্রতিনিধিকে।
ফিলিং স্টেশনে অভিযোগ করে একজন বলেন, আমি পাঠাও-ফাঠাও কোনটাতেই নাম লেখাবো না। কিন্তু এই পাঠাও প্রতিনিধিদের জন্য আমার মতো অনেকেই বিরক্ত। বলা নেই, কওয়া নেই, কোথা থেকে যে বের হয় তারপর কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকে। একদিন-দুইদিন ব্যাপারটি সহ্য করা যায় কিন্তু প্রতিদিন তো ভালো লাগে না। প্রতিষ্ঠানটি বড় হচ্ছে কিন্তু মার্কেটিং পলিসি খুব খারাপ এবং দুর্বল। তাদের পলিসি আরো ভালো করা দরকার।
তিনি আরো বলেন, শুধু এই সিএনজি ও ফিলিং স্টেশন নয়, ঢাকা শহরের সব সিএনজি ও ফিলিং স্টেশন একই সমস্যা। যেখানেই যাবেন তাদের প্রতিনিধি কোনো না কোনো জায়গা থেকে বের হবে এবং নাম না লেখানো পর্যন্ত অথবা আপনার তেল-গ্যাস নেয়ার আগ পর্যন্ত বারবার বলতে থাকবে রেজিস্ট্রেশনের জন্য। এটা যেন জোর করেই নাম লেখানো। ব্যাপারটি আমার চোখে খারাপ, অন্যদের কাছে কেমন লাগে সেটি জানি না।
গুলশান ১ নম্বর রবি অফিসের নিচে দাঁড়ানো মোজাম্মেল হোসেন বলেন, এটি আমার অভিযোগ পাঠাও কর্তৃপক্ষের কাছে। আমি আমার এক আত্মীয় এর জন্য দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু ১০ মিনিটে আমাকে পাঠাও এর চালক হিসেবে অন্তত ১০ জন প্রশ্ন করেছে। আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে এই বিষয়টি নিয়ে বেশ বিব্রত। অনেকে কেন আমি দাঁড়িয়ে আছি, যাবো না কেন সেটার জন্য কৈফিয়ত চাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। বিব্রত হয়েই আমি আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা না করেই স্থান ত্যাগ করেছি।
ভোগান্তির শিকার একজন জানান, বৃষ্টি নামের তার এক নিকট আত্মীয় পাঠাও রাইড শেয়ারিং সার্ভিস ব্যবহার করেছিল। পরবর্তীতে ওই রাইডার বিভিন্ন নম্বর থেকে বৃষ্টিকে সময় অসময়ে বিরক্ত করা শুরু করে। বৃষ্টি অভিযোগ জানিয়েছিল, তবে আজও এর কোনো সুরাহা হয়নি।
অন্য এক পাঠাও ব্যবহারকারী রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, গত তিন মাস আগে তিনি কারওয়ান বাজার থেকে মিরপুরে গেছেন পাঠাও বাইকের মাধ্যমে। রাইডের জন্য রিকোয়েস্ট দেয়ার সময় সর্বোচ্চ ভাড়া ২২০ টাকা দেখালেও গন্তব্যে পৌঁছে তিনি পরিশোধ করেন ২৯০ টাকা। এ বিষয়ে তিনি ও রাইডার তাৎক্ষণিক অভিযোগ জানান। তিনমাস অতিক্রম করলেও আজ পর্যন্ত ওই অভিযোগকারীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।
অভিযোগকারী আরো জানান, হেল্পলাইনে কল করলেও তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না।
আরো একজন অভিযোগকারী জানান, পাঠাও-এর কার শেয়ারিং সার্ভিস নিয়ে তিনিও পড়েছিলেন মহাবিপাকে। দ্রুত তাকে যেতে হবে একটি বিশেষ মিটিংয়ে যোগ দিতে, তাই তিনি পাঠাওয়ের রিকোয়েস্ট পাঠান। রিকোয়েস্ট গ্রহণের পর তাকে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে হয় আড়াই ঘণ্টারও বেশি। অভিযোগকারীর মোবাইল অ্যাপে গাড়িটি দেখায় ওয়াসা ভবনের আশেপাশে, কিন্তু রাইডারকে কল করলে সে জানায় গাড়িটি বাংলামটরে রয়েছে। এখানেই শেষ নয়, স্বল্প দূরত্বের রিকোয়েস্টগুলো রাইডার কর্তৃক বাতিল করার অভিযোগ অনেক আগে থেকেই রয়েছে।
নিয়মিত পাঠাও ব্যবহারকারী এক ব্যক্তি নামপ্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমি পাঠাও অ্যাপসটি চালু হওয়ার পর থেকে ব্যবহার করছি। শুরুতে জিপিএস সমস্যা, এরপর রাইডারের স্বল্পতা থেকে বর্তমানে আরো বিবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। একবার রাইড শেষ করার পর বারবার বাইকের চালক রাইড শেষ করার জন্য ‘এন্ড বাটন’ চাপলেও তা কাজ করছিল না। শেষে বাইকার আমার কাছ থেকে পূর্বে দেখানো ভাড়া নিয়ে চলে যায়। পরবর্তীতে আমি দেখেছি মোবাইলে বিল দেখিয়েছে ২ হাজার টাকা। সেই বাইকার জানিয়েছিল, ২ হাজার টাকা বিলের ওপর তাকে পাঠাওয়ের টাকাটা পরিশোধ করতে হয়েছে।
খিলগাঁও সিপাহীবাগ এলাকায় থাকা এক ব্যক্তি জানান, রাতে পাঠাও রাইডে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে সিপাহীবাগ বাজার পর্যন্ত বাইকে এসে আমি নেমে যাই। এ সময় বাইকার আমার কাছে ১০ টাকা বেশি দাবি করে। এটা আহামরি কোন টাকা নয়। কিন্তু তার চাওয়ার ভঙ্গি এমন ছিল, যে রাতে আমাকে নিয়ে আসায় তাকে বাড়তি ভাড়া দিতেই হবে। বিষয়টি নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়।
এ ছাড়া পাঠাওয়ের বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে যেগুলো ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে এবং গ্রুপে সার্চ করলে দেখা যাবে। সমস্যার কোনো সমাধান নেই। গ্রাহকদের সেবা নিশ্চিত করার কোনো পরিকল্পনা না নিয়েই প্রতিষ্ঠানটি তাদের মোটরবাইক ও প্রাইভেট কার নিবন্ধন করেই চলেছে। এতে করে যতটুকু সেবার পাবার কথা সেটুকু না পেয়েও আরো বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা।
এ সব বিষয়ে জানাতে পাঠাও-এর সিইও হুসেইন এম ইলিয়াসের যোগাযোগ করার জন্য তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে যোগাযোগের কল করা হলে তিনি রিসিভ করেনি।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন