ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্ম প্রসারিত হওয়ার পর বঙ্গজনপদে মুসলমানদের রীতি-রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত হয় মূলত মোগল আমলে। সুবে বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকা ছিল এর কেন্দ্রভূমি। গত চার শ বছরের অধিককাল থেকে সূচিত ইসলামী চর্চা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মুসলমানদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্ব রোজা। রোজা পালনের বিভিন্ন উপাদান লিপিবদ্ধ রয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও স্মৃতিকথায়, আর কিছু কথা লোকমুখে বংশপরম্পরায়। সব মিলিয়েই রমজানের বিবিধ প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন ঢাকা গবেষক সাংবাদিক আনিস আহামেদ
মুসলমানদের ফরজ ইবাদতের মধ্যে রমজানের গুরুত্ব দ্বিতীয়। হিজরি দুই সনের ১০ শাবান রোজা ফরজের ওহি নাজিল হয়। একই দিন কিবলা পরিবর্তন এবং জাকাত ও ফিতরার হুকুম জারি হয়। প্রতি হিজরি সনের নবম মাসে রমজান পালিত হয়। আরবিতে একে শাহারু রমাদান এবং ফারসিতে মাহে রমজান বলা হয়ে থাকে। ভারতবর্ষে যেহেতু ফারসি ভাষাভাষীর মুসলিম শাসকরা শাসনকার্য পরিচালনা করতেন, সেই হিসেবে আমরা মাহে রমজান বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
আমাদের দেশে ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দ থেকে নওমুসলিমরা রমজান পালন শুরু করে। সুলতানি আমলে সোনারগাঁ এবং মোগল আমলে ঢাকাকে কেন্দ্র করে মুসলিম রীতিনীতি ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করতে থাকে। সুলতানি আমলে ঢাকার নারিন্দায় প্রথম বিনত বিবি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ১৬১০ সালে ঢাকা আগমনের সময় সুবে বাংলার প্রথম মোগল সুবেদার ইসলাম খাঁ চিশতির সফরসঙ্গী মির্জা নাথান বাহারিস্তান গায়রি গ্রন্থে আড়িয়াল নদীবক্ষে রমজানের চাঁদ ওঠার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘কামান থেকে তোপ ছুড়ে ও বন্দুকের গুলিবর্ষণ করে রমজান মাসের আগমনী ঘোষণা করা হয়।’
মোগল আমলে সুবে বাংলার রাজধানী হিসেবে ৯৪ বছর এবং আমির-ওমরাদের অধীনে ৫৩ বছর ঢাকার জৌলুস বিদ্যমান ছিল। এ সময় ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে আসা মুসলমানদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা সংমিশ্রিত হয়ে ঢাকাইয়া সমাজের উদ্ভব ঘটে। পরবর্তী প্রায় ২০০ বছর ঢাকাইয়া সমাজ স্থায়ী রূপ লাভ করে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকার সমাজ নতুন আঙ্গিকে রূপান্তরিত হতে থাকে, যা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। প্রাচীন ঢাকা শহর তথা আজকের পুরান ঢাকায় মোগল ঐতিহ্যের ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে এখনো টিকে রয়েছে।
ঢাকাইয়াদের রমজান পালন পর্বের মধ্যে রয়েছে : ১. সাহরি, ২. ইফতার, ৩. তারাবি, ৪. কাসিদা, ৫. জাকাত।
সাহরি
ব্রিটিশ আমল থেকে সরকারিভাবে তিনবার সাইরেন বাজিয়ে সাহরির শুরু, মধ্যম ও অন্তের সময় ঘোষণা করা হতো। এর আগে মোগল আমল থেকে ঢাকার মহল্লা পঞ্চায়েতের গোরেদরা (ঘোষক) স্থানীয় উর্দু ও বাংলা ভাষায় সাহরির সময় রোজাদারদের জাগিয়ে দিত। স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই এ কাজে অংশগ্রহণ করত। তাদের বোল ছিল এ রকম—‘উঠঠো রোজদারও সেহেরি খা লও, রাত তিন বাজগিয়া।’ সাহরিতে ঢাকাইয়াদের মূল খাওয়া থাকত দুধ, ভাত, কলা ও আম। ঢাকাইয়ারা সাহরির শেষ প্রান্তে আহার গ্রহণ করে ফজরের নামাজ আদায় করে ফের ঘুমাতে যেত। এখন মসজিদের মাইকে সাহরির ঘোষণা চালু হওয়ায় গোরেদদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।
ইফতার
ঢাকাইয়ারা ইফতারের আহার পর্বকে রোজাখোলাই নামে অভিহিত করে থাকে। দুই যুগ আগ পর্যন্ত মসজিদগুলোতে মাইকের ব্যবহার কম থাকায় ইফতারের সময় সরকারিভাবে সাইরেন বাজানো হতো। ঘরে তৈরি এবং দোকান থেকে সংগ্রহকৃত ‘রোজাখোলাই’র পদের সংখ্যা শতাধিক। দেশি-বিদেশি ফলের তালিকা এর বাইরে। খেজুর ও পানি দিয়ে ইফতার পর্বের সূচনা ঘটে। শেষ হয় মাখানো বাহারি মুড়িভর্তা দিয়ে। এর মিশ্রণপ্রক্রিয়া মসলাপাতি খাস ঢাকাইয়া না হলে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। হাকিম হাবিবুর রহমান তাঁর ঢাকা পাচাশ বারাস পাহেলে গ্রন্থে ঢাকাইয়া ইফতারের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি এ কথাও বলেছেন, “জীবনে প্রথম রোজা সূচনাকারী শিশু-কিশোরদের নিয়ে রোজার প্রথম দিন জুলুসের (ধর্মীয় শোভাযাত্রা) প্রচলন ছিল। ঢাকার চকবাজারের ইফতার বাজার মোগল আমল থেকে চালু হয়ে এখন পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে টিকে রয়েছে। উপমহাদেশে এত বড় ইফতার বাজার আর কোথাও নেই।
২০ রমজানের ইফতারের সময় চালের চাপড়ি ও কচুশাক খাওয়া এবং ২৭ রমজানে মসজিদে বিশেষ ইফতার পাঠানোর প্রচলন ছিল। এ ছাড়া প্রতিদিন ইফতারের আগে মহল্লার মসজিদে রোজাখোলাই পাঠানো হয়ে থাকে। ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন আত্মীয়দের বাড়িতে সিনি (বড় পাত্র) ও খানপোস (কাপড়ের ঢাকনা) দিয়ে সাজিয়ে ইফতার পাঠানোর রেওয়াজ ছিল।
হবু বরেরা বিয়ের আগে এবং নতুন বধূর বাড়ি থেকে বিয়ের পরে বাহারি পদের ইফতার ও ফলমূলের একাধিক খাঞ্চি ভরে ‘ডালা’ পাঠানো হতো। বিয়ের পর প্রথম রমজানে নববধূ মায়ের বাড়িতে অবস্থান করত। নতুন বরের বাড়িতে ঘি ও মুরগি পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। মহল্লার প্রত্যেক মসজিদে এখনো ইফতারের ব্যবস্থা রয়েছে। এতে মুসাফির, ভিক্ষুক ও দরিদ্ররা অংশ নিতে পারে।”
৮৩ বছর বয়সী আমলিগোলা নিবাসী প্রবীণ সাকিয়া বানু বলেন, ‘ঢাকাইয়াদের ধারণা, রমজান মাসের খরচের কোনো হিসাব কিয়ামতের দিন দিতে হবে না। তাই তারা রমজানে ইফতার (রোজাখোলাই), সামরাত কা খানা (রাতের আহার) ও ভোররাত কা খানায় (সাহরি) বেহিসাবি খরচ করে থাকে।’ তিনি আরো বলেন, ‘হাজিদের সংগৃহীত জমজম কূপের পানি বছরের পর বছর কাচের বোতলে সংরক্ষণ করা হতো। প্রথম রমজানে ইফতারের সময় খাবার পানিতে তা মিশ্রিত করে পরিবেশন করা বনেদি পরিবারের রেওয়াজ ছিল।’
তারাবি
ঢাকাইয়ারা তারাবির নামাজকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাদের ধারণা, তারাবি আদায় না করলে রমজানের পরিপূর্ণতা অর্জিত হয় না। প্রথম দিকে সুরা তারাবির ব্যাপকতা থাকলেও দেওবন্দ ধারার মাদরাসা থেকে স্থানীয় আলেমরা হেফজ করে আসতে থাকায় বিগত ১০০ বছরে খতম তারাবি ক্রমান্বয়ে স্থান করে নিয়েছে। ২৭ রমজান খতম তারাবি শেষ হয়। বর্তমানে অনেক মসজিদে নারীদেরও পৃথক তারাবি নামাজ জামাতে অনুষ্ঠিত হয়। বেগমবাজার নিবাসী প্রবীণ সিরাজুল ইসলাম বলেন, তিনি তাঁর শৈশবে তারাবিতে অংশগ্রহণকারী মুসল্লিদের মধ্যে তারাবি শেষে স্থানীয় বিত্তবানদের পর্যায়ক্রমে দুধ ও শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করাতে দেখেছেন। খতম তারাবির দিন নামাজ শেষে মসজিদে মসজিদে বিরিয়ানি এবং মিষ্টি বিতরণ করা হতো। বর্তমানে মহল্লার মসজিদগুলোয় ইতেকাফকারীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। ঢাকাইয়া সামর্থ্যবানরা এখন ব্যাপকভাবে রমজান মাসে ওমরাহ পালন করতে মক্কায় গমন করেন।
কাসিদা
মোগল সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ঢাকায় কাসিদার আবির্ভাব ঘটে। রাজবন্দনা, আল্লাহ-নবীর বন্দনা, বিভিন্ন ধর্মীয় পর্বের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব প্রকাশ করা হয় কাসিদার মাধ্যমে। প্রথমে এটা ফারসি ও উর্দুতে রচিত হলেও পরে ঢাকার স্থানীয় হিন্দুস্তানি ভাষায় কাসিদার প্রচলন হয়। উনিশ শতকের পর ঢাকায় রমজান মাসে সাহরির সময় কাসিদা পাঠ করে রোজাদারদের ঘুম ভাঙানোর প্রথার সূচনা ঘটে। কাসিদা সম্পূর্ণ মুসলিম পর্ব। উনিশ শতকের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পুরান ঢাকায় রমজান ও ঈদ কেন্দ্র করে কাসিদার চর্চা অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিককালে বাংলা ভাষায় কাসিদার চর্চা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন মহল্লায় কাসিদা প্রতিযোগিতাও হয়ে থাকে।
রমজানের কাসিদা তিন ভাগে বিভক্ত : ১. চানরাতি আমাদ : রমজান মাসকে স্বাগত জানানো হয় এর মাধ্যমে, ২. খোশ আমদেদ : রমজানের মধ্যভাগ পর্যন্ত রমজানের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়, ৩. আল-বিদা : রমজান মাসকে বিদায় জানানো হয় বিরহমূলক কাসিদার মাধ্যমে। যেহেতু হজরত আলী (রা.) রমজানের ১৯ তারিখে খঞ্জরবিদ্ধ হন এবং ২১ রমজান ইন্তেকাল করেন, তাই আল-বিদা কাসিদায় হজরত আলী (রা.)-এর জন্য শোকগাথা পরিবেশিত হতো। এ ছাড়া ছিল ঈদের কাসিদা। ঈদ উৎসব ও ঈদ মিছিলে খুশির ফোয়ারা ছুটত ঈদের কাসিদায়। কাসিদায় একজন লোকমাদার (মূল গায়ক) থাকেন। তাঁর কথা শেষ হলে দলবদ্ধভাবে কোরাস গাওয়াই হলো কাসিদার রীতি। একটি কাসিদার বোল ‘রোজদারও জাগো ওঠো, এ রাত সোহানি হ্যায়’—(রোজাদাররা ঘুম থেকে ওঠো, এ রাত অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ)।
জাকাত
রমজান মাসের সঙ্গে জাকাত প্রদানের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত। ঢাকাইয়ারা আগে ব্যক্তি ও পরিবারকে জাকাত প্রদান করতেন। ইদানীং অগ্রাধিকার পাচ্ছে মাদরাসা, এতিমখানা। মহল্লার বিধবা, এতিম, নিকটাত্মীয়-স্বজনদের শাড়ি, লুঙ্গি, হাতাওয়ালা গেঞ্জি, জামাকাপড় দেওয়া হতো। দরিদ্র পরিবারকে রান্নার সামগ্রী (চাল, ডাল, ছোলা, বুট, চিনি, তেল, সেমাই) প্রদান করা হতো। এখনো অনেক মহল্লায় এই রেওয়াজ প্রচলিত আছে।
বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোক বাস করে। প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব রান্নাবান্না। পুরনো আর নতুনের মিশ্রণে ঢাকাবাসীর ইফতার-সাহরির আয়োজনে আরো বৈচিত্র্য এসেছে। প্রবাসীরা নিয়ে এসেছেন নতুন নতুন খানাপিনা। ইলেকট্রনিক মাধ্যমগুলো রমজান মাসে ভোজন রেসিপি প্রচার করে। শহর ঢাকার ঐতিহ্যই হচ্ছে সব কিছু আত্মস্থ করা। তবু ঢাকার রমজানের পুরনো ঐতিহ্য চুম্বকের মতো টানে দেশবাসীকে। নতুন ঢাকার অনেক মানুষ ছুটে যান চকবাজারে ইফতারি কিনতে। আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবের বাসায় যেচে দাওয়াত নেন অনেকে। পুরান ঢাকায় রমজান মাসে দিনে অথবা রাতে যে-ই পা ফেলবেন, তার চোখে ধরা পড়বে পুরান ঢাকার রমজানের ঐতিহ্য। খোশ আমদেদ মাহে রমজান—আসসালাম।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন