আর কয়েকদিন পরই ঈদ। বাড়ি ফেরার জন্য ইতিমধ্যে অনেকে কাজকর্ম গুছিয়ে নিয়েছেন। আর এই ঈদে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক দিয়ে ঘরমুখী মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারবেন কি না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
দীর্ঘদিন থেকে কাজ চলছে এই মহাসড়কের। বিশেষ করে বহদ্দারহাট থেকে আনোয়ারা ক্রসিং পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের অবস্থা বেহাল। মহাসড়কটি পুরোটাই ন্যাড়া হয়ে পড়েছে।
সড়ক বিভাগ কোথাও কিছু আস্ত ইট, আবার কোথাও ইটের টুকরো দিয়ে মহাসড়ক ‘যানবাহন চলাচল উপযোগী’ করলেও দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে গন্তব্যে পৌঁছাতে। পুরো সড়ক পার হতে তীব্র ঝাঁকুনির ধকলতো যাত্রীদের রয়েছেই। তা ছাড়া সামান্য বৃষ্টিতে ময়লা কাদা ও সড়কের সৃষ্ট গর্তে শাহ আমানত সংযোগ সড়কের অবস্থা এখন খুবই নাজুক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাস্তাঘাট ভেঙেচুরে বেহাল হয়ে যাওয়ার কারণে সড়ক দিয়ে চলাচলকারী গাড়িগুলোকে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। ভাঙা সড়কের গর্ত ও অধিকাংশ স্থানে নুড়িপাথরের প্রলেপ না থাকার কারণে গাড়ি চলাচল বিঘ্ন হয়ে বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘ যানজট তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি গাড়ির মূল্যবান যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে বলেও সংশ্লিষ্টদের দাবি। ফলে যোগাযোগ ক্ষেত্রে বিরাজ করছে চরম অনিশ্চয়তা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এরমধ্যে শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণ পাড়ে ৩ কিলোমিটার সড়কে মোটামুটি চলাচলের সুবিধা পাবে যাত্রীরা। এক কিলোমিটারের মতো সড়কের কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। ৩ কিলোমিটারের মধ্যে ২ কিলোমিটার সড়কে একমুখী যানবাহন চলাচল করতে পারবে।
অন্যদিকে সেতুর শহরের দিকে অংশের ৫ কিলোমিটার সড়কের কাজ বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। ফলে এই ঈদে দুর্ভোগ পোহাতে হবে এই সড়কে চলাচলকারী বিপুল সংখ্যক যাত্রীদের।
নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন, আগেই থেকে বিকল্প ব্যবস্থা না রাখার কারণে আসন্ন ঈদে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষদের।
কথা হলে হানিফ এন্টাপ্রাইজের চালক রশিদ আহমেদ বলেন, ‘নতুন চান্দগাঁও থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত যেতে সময় লাগে ৪০ মিনিট। যেখানে আগে সময় লাগত ১৫ মিনিট। তা ছাড়া সড়কে প্রচণ্ড কাদা এবং ছোট বড় অসংখ্য গর্ত। গাড়ি চালাতে খুব কষ্ট হয়।’
বাশঁখালী সুপার সার্ভিসের চালক বাচ্চু বলেন, ‘গাড়ি চালিয়ে ভাত খেতে হয়। সড়কের যে অবস্থা রাতে অনেক সময় অসুস্থতাবোধ করি।’ এরকম অসংখ্য অভিযোগ চালকদের।
পথচারী নুরুল কবির বলেন, ‘এ সড়কের কী কোনো মা-বাপ নেই। কেউ কি দেখছে না। বর্ষা আসলে দেখি কাজ চলে। সারা বছর তারা কোথায় থাকে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগরের সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, ‘বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। তা ছাড়া সড়কের মাঝখানে ঘেরাও দিয়ে চলছে সড়কের কাজ।
রাস্তা সরু হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত লেগে থাকে যানজট। এসব সড়কে গাড়ি চালাতে গিয়ে অনেক মূল্যবান যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী দুই-তিন মাস পর আমাদের অর্ধেক গাড়ি আর সড়কে নামতে হবে না। অকেজো হয়ে যাবে।’
তা ছাড়া এবারের ঈদে ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না বলেও জানান বেলায়েত হোসেন বেলাল।
সড়ক বেহালে।
বেহালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। ছবি : প্রিয়.কম
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হবে বলে জানান এই সড়কের কাজ পাওয়া যৌথ প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার কনস্ট্রাকশনের প্রজেক্ট ম্যানেজার আবু সাহদাত সায়েম। তিনি বলেন, ‘শাহ আমানত ব্রিজের দক্ষিণে পটিয়ার প্রান্তে ৫০ ভাগ ও শাহ আমানত ব্রিজের উত্তরে বহদ্দারহাট পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার সড়কের ৩০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।’
আবু সাহদাত বলেন, ‘গত বছর কাজ পাওয়ার পর থেকে শুরু হয় বর্ষা। এ কারণে ছয় মাস কাজ বন্ধ ছিল। তারপর কাজ শুরু করলে আবার চলে আসে বর্ষা। এরপরও বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাজ দ্রুত গতিতে চলছে। যেভাবে কাজ চলছে তাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে।’
সংযোগসড়ক উন্নীতকরণ কাজে নিয়োজিত সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আশিক কাদির জানান, শাহ আমানত সেতু উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে সংযোগসড়ক উন্নীতকরণের কাজে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত ১৩টি মামলা মোকাবিলা করতে হয়েছে। এ মামলা জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছে।
আশিক কাদির আরও জানান, চীনের ডব্লিউএমসিজি, ফাদেম আল কুয়েত ও মীর আক্তারসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে সড়ক উন্নীতকরণের কাজ করছে। এই প্রকল্পের মধ্যে চট্টগ্রাম প্রান্তে চারটি আরসিসি ব্রিজ, দুইটি আন্ডারপাস (একটি কালামিয়া বাজার অপরটি রাহাত্তারপুল এলাকায়), একটি বড় কালভার্ট ও সেতুর পটিয়া প্রান্তে সাতটি কালভার্ট রয়েছে।
সূত্রমতে, ২০১০ সালে ১০ সেপ্টেম্বর হজরত শাহ আমানত (রহ.) সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেতু নির্মাণ হলেও উভয় প্রান্তে সংযোগ সড়ক অপ্রশস্ত হওয়ায় সেতু প্রান্তে যানজট লেগেই থাকে। এ কারণে সেতুর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ।
বিষয়টি বিবেচনায় এনে সেতু প্রকল্পের উদ্বৃত্ত (২৭০কোটি ১১ লাখ) টাকায় সেতুর উভয় প্রান্তে আট কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণের সিদ্ধান্ত নেয় সড়ক ও জনপথ (সওজ)। এর মধ্যে চট্টগ্রাম প্রান্তে সেতু থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার ছয় লেন ও পটিয়া প্রান্তে মইজ্যারটেক থেকে আনোয়ারা ক্রসিং পর্যন্ত তিন কিলোমিটার চার লেন রাস্তা রয়েছে।
সেতু উদ্বোধনের বছর সংযোগসড়ক প্রশস্তকরণের সিদ্ধান্ত হলেও নানা জটিলতা কাটিয়ে প্রায় আট বছর পর সেতুর উভয় প্রান্তে চার ও ছয় লেন সড়কের কাজ শুরু হলেও তা চলছে ধীরগতিতে। এ কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও সাদার্ন ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য প্রকৌশলী আলী আশরাফ বলেন, ‘শুধু শাহ আমানত সংযোগ সড়ক নয়, চট্টগ্রামের অধিকাংশ সড়কের ভয়াবহ অবস্থা। উন্নয়ন-সংস্কারের নামে দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে আছে গুরুত্বপূর্ণ এসব সড়ক।
বাণিজ্যনগরীর সড়কগুলো এভাবে অভিভাবকহীন পড়ে থাকা পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বন্দর থেকে পণ্য খালাস করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছাতে সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে। উন্নয়নকাজে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বয় না থাকায় চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়েছে।’
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, পরিকল্পিত উন্নয়নের সমন্বয়ে যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আর এ কারণে নগরজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। মন্ত্রী, এমপিসহ সরকারি সব সংস্থার সমন্বিত কাজ না হওয়ায় সরকারের সব উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন