নিয়মিত অফিস না করার অভিযোগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব হারানোর পর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে প্রথমে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হয়েছিল। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হলেও তিনি তার মতো করেই দিন কাটাচ্ছেন। তাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইলে মন্ত্রীর স্বাক্ষর ছাড়াই অনুমোদন দিতে হচ্ছে। অথচ আইনগতভাবে একজন মন্ত্রীই মন্ত্রণালয়ের প্রধান। মন্ত্রণালয়ের সফলতা বা ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকেই দায়দায়িত্ব বহন করতে হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যেসব ফাইল মন্ত্রীর স্বাক্ষর ছাড়াই অনুমোদন করা হচ্ছে সেসব ফাইলে মন্ত্রীর স্বাক্ষরের স্থানে লেখা থাকছে 'তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ' বা 'দেশের বাইরে আছেন'।
এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যায়যায়দিনকে বলেন, স্বাভাবিকভাবে যেসব ফাইলে মন্ত্রীর স্বাক্ষর থাকবে না সেসব ফাইলের জন্য তার কোনো দায়িত্ব নেই। তবে বিষয়টি ফাইলের গুরুত্বের ওপর নির্ভর করবে। কারণ, একজন মন্ত্রী যেহেতু একটি মন্ত্রণালয়ের প্রধান সেহেতু তার ওপর সব দায়দায়িত্ব বর্তায়।
মানবাধিকতার বিষয়ক আইনজীবী মনজিল মোর্শেদ যায়যায়দিনকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের কতগুলো দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে ন্যস্ত করা হয়। যেমন, অনেক ফাইলের ক্ষেত্রে বলা হয় সচিব পর্যন্ত মীমাংসা হয়ে যাবে। অনেক ফাইল মন্ত্রী পর্যন্ত যাবে। আবার যদি মন্ত্রী বলে দেন যে প্রতিমন্ত্রী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন সে ক্ষেত্রে আইনগতভাবে কোনো বাধা নেই। আর যে ফাইলে মন্ত্রী স্বাক্ষর করছেন না সে জন্য তিনি দায়ী হবেন না। তবে মন্ত্রণালয়ের সার্বিক দায়িত্ব মন্ত্রীর ওপরই থাকে। ফলে মন্ত্রণালয়ের যদি কোনো দুর্বলতা থাকে বা পারফরম্যান্স খারাপ হয় সে ক্ষেত্রে মন্ত্রীকে দায়িত্ব নিতে হয়। কারণ, আইনগতভাবে একজন মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের প্রধান, তার নির্দেশে মন্ত্রণালয় চলবে। তবে কোনো মন্ত্রণালয়ে যদি প্রতিমন্ত্রী থাকেন এবং মন্ত্রী বলে দেন যে প্রতিমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সভার সভাপতিত্ব করবেন বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে সে ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই।
জানা যায়, নতুন মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিয়মিত অফিস না করলেও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছেন। এছাড়া আগের তুলনায় মন্ত্রিসভার বৈঠকেও তার উপস্থিতির হার বেশি। আর মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে প্রতিমন্ত্রীকে ফাইলে স্বাক্ষর করে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার অনুমতি দেয়ায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মতো জনপ্রশাসনে কোনো ফাইল জমা নেই। এখন তার অনুপস্থিতিতে প্রতিমন্ত্রীর স্বাক্ষরের মাধ্যমেই বিভিন্ন ফাইল চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। আর মন্ত্রীর স্বাক্ষরের স্থানে অনুপস্থিতির কারণ ব্যাখ্যা করা হয়। তবে মন্ত্রী দেশে থাকলে তার সহকারী একান্ত সচিব এ কে এম সাজ্জাদ হোসেন মন্ত্রণালয় থেকে ফাইলপত্র বাসায় নিয়ে যান। স্বাক্ষর শেষে তা আবার মন্ত্রণালয়ে ফিরিয়ে দেন। আর মন্ত্রী দেশে না থাকলে ফাইল যত গুরুত্বপূর্ণই হোক কেন তা আর তার স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষা করা হয় না। কোনো ক্ষেত্রে দেশে থাকলেও ফাইল মন্ত্রীর বাসায় পাঠানো হয় না। প্রতিমন্ত্রীই সিদ্ধান্ত দেন। মন্ত্রী অফিসে না যাওয়ায় তার দপ্তরও প্রায় সব সময় ফাঁকা থাকে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক যায়যায়দিনকে বলেন, মন্ত্রী যখন বিদেশে থাকেন তখন প্রতিমন্ত্রীর মাধ্যমে ফাইল অনুমোদন হয়ে যায়। এছাড়া মন্ত্রী বিদেশে থাকলে স্বাক্ষরের প্রয়োজন হয় না, দেশে থাকলে প্রয়োজন হয়। তিনি বলেন, উনি নিয়মিত অফিস না করলেও মন্ত্রণালয়ের কাজে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। মন্ত্রণালয়ের কাজ ঠিক মতোই চলছে। মন্ত্রীর জন্য কোনো ফাইলও পেন্ডিং নেই।
এ বিষয়ে জানার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল দেয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি। তাই কথা বলা সম্ভব হয়নি।
মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মহাজোট সরকারের ৫ বছরে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজ দপ্তরে অফিস করেছিলেন মাত্র ২০ থেকে ২৫ দিন। এরপর তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পাঁচ মাস পর সচিবালয়ে দ্বিতীয় দিনের মতো নিজ দপ্তরে অফিস করেন। এর ফলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রায় চারশ ফাইল আটকে যায়। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এলজিআরডিমন্ত্রী থাকাবস্থায় শুধু যে অফিস করতেন না তা নয়, মাসের পর মাস তার দপ্তরে বহু ফাইল পড়ে থাকত। অনেক সময় জনগুরুত্বপূর্ণ ফাইলের হদিসও মিলত না। কিছু ফাইল অফিসে, কিছু বাসায় থাকতো। এভাবে ফাইল নিয়ে রীতিমতো টানাটানি হতো। এসব কারণে ২০১৫ সালের ৭ জুলাই একনেক সভায় সৈয়দ আশরাফকে না দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসন্তোষ প্রকাশ করেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশিত হয়। তখন তাকে সরানোর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লেও তা গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দুদিন পর ৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে সেই গুঞ্জন সত্যে পরিণত হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে আশরাফকে সরিয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং আশরাফকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। তবে এর এক সপ্তাহ পর ২৬ জুলাই সৈয়দ আশরাফকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। সরকারপ্রধানের অধিনস্থ এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রথমবারের মতো একজন মন্ত্রীকে দেয়া হয়। এরপরও তিনি আগের মতোই নিয়মিত অফিস না করেই দিন কাটাচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৯৬ সালে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী হন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী হন। তবে ২০১৫ সালের ১৬ জুলাই তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন