রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তালিকাভুক্ত দোকানেই নিয়ম-নীতির পরোয়া না করে অনেকটা ফ্রিস্টাইলে বিক্রি হচ্ছে পুলিশ-র্যাবের পোশাক-সরঞ্জাম। ফলে এসব পোশাক ব্যবহারকারীরা আসল র্যাব-পুলিশ, না নকল তা বোঝার উপায় থাকছে না। এতে করে তৈরি হচ্ছে নানা বিভ্রান্তি। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ইউনিফর্ম পরা সব মানুষই আসল না নকল, তা নিয়ে সন্দেহ জোরালো হয়েছে র্যাব-পুলিশের পোশাক পরা ভুয়া সদস্য গ্রেফতারের পর। ভুয়ারা এসব পোশাক ব্যবহার করে নানা অপরাধমূলক তৎপরতায় লিপ্ত হচ্ছে। সূত্র বলছে, এ অবস্থায় ইউনিফর্ম-সরঞ্জাম উগ্রপন্থি
জঙ্গিদের হাতে চলে যাওয়ারও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তখন আসল-নকল নিশ্চিত হওয়ার আগেই ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে বড় ধরনের দুর্ঘটনার। সূত্র জানায়, সম্প্রতি এসব বিষয় উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। চিঠিতে প্রস্তাব করা হয়েছে, কেবল কনস্টেবল থেকে উপপরিদর্শক পর্যন্ত নয়, আইজিপি পর্যন্ত ইউনিফর্ম বাহিনী থেকে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে। সূত্র জানায়, পুলিশের প্রবিধানে (পিআরবি) পুলিশি সরঞ্জাম খোলাবাজারে বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা নেই, তবে এ পোশাক বিক্রি বেআইনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর পলওয়েল মার্কেট ও রজনীগন্ধা সুপারমার্কেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকা নিবন্ধিত দোকানগুলোতে নিয়ম-নীতির পরোয়া না করে বিক্রি হচ্ছে র্যাব-পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক। এসব সরঞ্জামের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পুলিশ-র্যাবের কটি, হাতকড়া, লাইটিং ডিটেক্টর, ব্যাজ, বাঁশি, ক্যাপ, বেল্ট, জুতা, পিস্তল কাভার। এই সুযোগ ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। আবার অনেক সময় অপরাধীরা ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করে সংগ্রহ করছে এসব সামগ্রী। মাঝেমধ্যে ভুয়া র্যাব-পুলিশ গ্রেফতার হলেও ঠেকানো যাচ্ছে না অবৈধভাবে ইউনিফর্ম ও সরঞ্জাম বিক্রি। এতে করে ভাবমূর্তি সংকটে পড়ছেন পুলিশ ও র্যাবের আসল সদস্যরা। এর বাইরে চাকরিচ্যুত বা অবসরে যাওয়া কিছু পুলিশ সদস্য তাদের ব্যবহূত পোশাক জমা না দিয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করে দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
পলওয়েল মার্কেটের গাজীপুর পুলিশ স্টোরের মালিক নিতাই দত্ত এ প্রতিবেদককে জানান, পরিদর্শক থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের পোশাক পুলিশ সদর দফতর থেকে নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচয়পত্র দেখেই তিনি বিক্রি করেন। তবে গত শনিবার র্যাব-২ এর অভিযানে গ্রেফতার আটজন ভুয়া ডিবির সদস্য জানিয়েছেন, নীলক্ষেত থেকে তারা পরিচয়পত্র তৈরি করেছিলেন। এরপর রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ডিবির জ্যাকেটসহ অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করেছেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় র্যাব-পুলিশ-আনসার বাহিনীর মনোগ্রামসহ নিখুঁত আইডি কার্ড তৈরি করছে দুষ্কৃতকারীরা। ওই সব কার্ডে অপরাধীরা নিজের নাম লিখে, ছবি বসিয়ে বনে যাচ্ছে পুলিশ বা র্যাবের বড় কর্তা। প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে এক কার্যনির্বাহী আদেশে পুলিশের পোশাক ব্যবহার সাধারণের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এরপরও বিভিন্ন সিকিউরিটি কোম্পানি, পাড়া-মহল্লার দারোয়ান ও নাইটগার্ডরা অহরহ র্যাব-পুলিশের মতো পোশাক ব্যবহার করছে। তারা পুলিশের মতো হাতকড়া, র্যাঙ্ক ব্যাজও ব্যবহার করছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের উপ-মহাপরিদর্শক মহসিন হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে কিছু প্রতারক সাধারণ লোকজনের সঙ্গে প্রতারণা করছে। মাঝেমধ্যেই তারা ধরা পড়ছে। এসব প্রতারক ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পুলিশের পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রির জন্য নীতিমালা রয়েছে। কেউ অমান্য করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বর্তমানে পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তারা সরকারিভাবে সরবরাহ করা পোশাকসামগ্রী ব্যবহার করেন। কিন্তু পরিদর্শক থেকে শুরু করে আইজিপি পদমর্যাদার কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে পোশাক কিনে ব্যবহার করেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে পুলিশের পোশাক সরবরাহের বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। পুলিশের কোনো কর্মকর্তা যেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে পোশাকসামগ্রী না কিনতে পারেন, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। নইলে পুলিশের পোশাক জঙ্গিদের কাছে চলে গেলে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে গোলকধাঁধায় ফেলতে পারে। প্রস্তাবনায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, পুলিশের পরিদর্শক থেকে তার ওপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পোশাক সরকারিভাবে সরবরাহ করতে অতিরিক্ত কোনো অর্থের প্রয়োজন হবে না। এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) ও সিআইডি (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট) ছাড়া পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কিট ভাতা বাবদ প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হয়। এ টাকা দিয়েই সরকারিভাবে পোশাকসামগ্রী কিনে সরবরাহ করা সম্ভব। সূত্র বলছে, পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হকের পক্ষে অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (সরবরাহ) রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব ৩০ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবটি পাস হলে পুলিশের সব সদস্যকেই সরকারিভাবে সরবরাহ করা পোশাকসামগ্রী ব্যবহার করতে হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে পোশাক কেনা বা তৈরির কোনো সুযোগ থাকবে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক রেজাউল করিম বলেন, পরিদর্শক থেকে ওপরের কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে পোশাকসামগ্রী কেনায় পোশাকের রং ও মানে ভিন্নতা দেখা দেয়। এতে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। আবার মেট্রোপলিটন, জেলা পুলিশ, এপিবিএন ও এসপিবিএনের পোশাকসামগ্রী ভিন্ন হওয়ায় বদলিজনিত কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পোশাকও পরিবর্তন করা হয়। এতে তারা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। এসব কারণসহ নানা কারণে সরকারিভাবে পোশাক সরবরাহ বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবে ইউনিফর্মের তিনটি প্যান্ট এবং চারটি শার্টের কথা বলা হয়েছে। জানা গেছে, অবৈধভাবে পুলিশের পোশাকসামগ্রী বিক্রির অপরাধে গত বছরের জুনে পলওয়েল সুপারমার্কেটের ৮টি দোকানের ১৩ জন মালিক-কর্মচারীর বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা করা হয়। প্রাধিকারভুক্ত (পাওয়ার যোগ্য) পুলিশ সদস্যদের জন্য কেনা পোশাক বিক্রির অপরাধে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিরপুর ১৪ নম্বরের একটি দোকান ও চার মালিক-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় মামলা করা হয়। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহ্মুদ খান বলেন, র্যাবের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধ হয়েছে, অপরাধী ধরাও পড়েছে। তবে র্যাবের পোশাক পরে অপরাধের অভিযোগ আমরা পাইনি। এরপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইউনিফর্ম ও সরঞ্জামাদি বিক্রি আরও কঠোর নিয়মের মধ্যে আনা প্রয়োজন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন