বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়ি বহরে হামলা এবং তাকে শারিরীকভাবে আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে আমাদের অসুস্থ রাজনীতির অসভ্য কর্মকাণ্ডের চিত্রপট আবার উদ্ভাসিত হয়েছে। কি সরকারি দল, কি বিরোধী দল, কি সাধারণ মানুষ; বিবেকবান সবাইকে বিক্ষুদ্ধ করেছে। এ ঘটনা রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার ও সংস্কৃতিতে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এই ঘটনার সঙ্গে দায়ীদের ছাড় দেয়া হবে না। এই ঘটনায় তিনি নিন্দা জানিয়ে একটি বড় রাজনৈতিক দলের বড় নেতার পরিচয়ই দিয়েছেন।
কিন্তু ঘটনার দিন নির্বাচনী এলাকায় থাকা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ এটিকে বিএনপির নাটক বলে যে মন্তব্য করেছেন, সেটি রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার বর্হিভূতই নয়। এটি হামলাকারীদের বা অন্যায়কারীদের প্রশ্রয়দানের সামিল। ড. হাছান মাহমুদও উচ্চ শিক্ষিত ও সাবেক মন্ত্রীই নন, একজন রাজনীতিবিদ। মনে রাখতে হবে যে, রাজনীতি যদি রাজনীতিবিদদের হাতে রাখতে হয়, তাহলে রাজনীতিতে নানা মত পথ থাকলেও রাজনৈতিক নেতাদেরকেই সকল রাজনীতিবিদদের মান মর্যাদার রক্ষা করা দায়িত্ব। আজ যে রাজপথে কাল সে ক্ষমতায় আসতে পারে। আজ যে ক্ষমতায় কাল সে রাজপথে যেতে পারে। ক্ষমতার দম্ভ, উন্মাসিকতার কোন দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না।
বিএনপি দাবি করেছে, শাসক দলের কর্মীরা পাহাড়ের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দুর্গত মানুষদের ত্রাণ দিতে যাওয়ার সময় বিএনপি মহাসচিবের ওপর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় হামলা চালিয়েছে। নিটক অতীতে এই সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যার পর সরকারি দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হলো- এই ঘটনা জামায়াত-শিবির ঘটিয়েছে। কিন্তু পুলিশকে স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে দেয়ার পর বেরিয়ে আসলো হত্যাকাণ্ড ওই এলাকার সাবেক জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ঘটিয়েছেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর যারা হামলা চালিয়েছেন তাদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এদেরকে গ্রেফতারে পুলিশের বিলম্ব হওয়ার কথা নয়। আমরা চাই, সংবিধান ও আইন, বিধি-বিধান অনুয়ায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা হবে। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। হামলাকারীরা যে দলেরই হোক চিহ্নিত হওয়ার পর তাদেরকে নিজ নিজ দল থেকে বহিষ্কারই নয় শাস্তিও আইন অনুযায়ী দিতে হবে।
অতীতে অনেক রাজনীতিবিদদের ওপরই নয়, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে অসংখ্যবার হামলা হয়েছে। আমাদের রাজনীতি কলংকিত হয়েছে। নিন্দার ঝড় ওঠেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গাড়ি বহরেও অনেকবার হামলা হয়েছে। সেইসব হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো সরকারই ব্যবস্থা নেয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার পরিজনসহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সামরিকতন্ত্রের যে রাজনীতি শুরু হয়েছিল, সেই ধারায় এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ওপর রাজপথ থেকে আটক অবস্থায় অবর্ণনীয় নির্যাতন হয়েছে। এই নির্যাতন শাসকরা ক্ষমতার দ্বম্ভে চালালেও তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী হয়নি। দুনিয়াতেই তারা করুণ পরিণতি ভোগ করেছেন।
বিএনপি জামানায় তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে বিএনপি দলীয় ক্যাডাররা যে বর্বর হামলা চালিয়েছে, তাদেরকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। তাদের মদদদাতাদের নির্বাসিত করুণ জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ১৪ দলের নেতাদের ওপর যারা জাতীয় রাজনীতিতে মানুষের অধিকারের সংগ্রাম করেছেন আজীবন, তাদের ওপর হয় পুলিশ নয় শাসক দলের কর্মীদের দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। এর পরিণতি চড়া মাশুলে তাদের গুণতে হয়েছে।
ফার্মগেটে মতিয়া চৌধুরী, পল্টনে মরহুম আব্দুস সামাদ আযাদ, মোহাম্মদ নাসিম আহত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ১৪ দলের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, দিলীপ বড়ুয়াদের আহত করা হয়েছিল। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর খুনিচক্র ও সামরিক শাসকরা সারাদেশের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের জেলেই পুরেননি, হাত বেঁধে, চোখ বেঁধে নির্যাতন করেছিলেন। খুনিচক্র তোফায়েল আহমেদের মতো নেতাকে চোখ বেঁধে নিয়ে এতটাই নির্যাতন করেছিল যে, তাকে যখন শাহবাগ কন্ট্রোল রুমে এনে ফেলে রাখা হয়; তখন সারারাত বন্দী মরহুম রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমান ও আব্দুর রাজ্জাক সেবাশুশ্রষা করেছিলেন। কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় ৪ নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সেই খুনিদের ফাঁসি হয়েছে। শাসকদের করুণ পরিণতি ঘটেছে।
১৯৮০ সালের ৩ নভেম্বর হরতালের রাজপথে হাইকোর্টের সামনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মরহুম আব্দুর রাজ্জাককে রাস্তায় ফেলে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের পুলিশ পিটিয়েছিল। টানা তিন মাস অন্ধকার কক্ষে বন্দী রেখে মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা নুরে আলম সিদ্দিকীর ওপর।
সকল সরকারের আমলেই পুলিশ দিয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের মামলা, কারাদহন ও দমন-নির্যাতন করার চেষ্টা হয়েছে। রাজনীতিবিদরা নির্যাতিত হলেও শাসকদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী হয়নি। সেনাশাসক এরশাদের জামানায় দুই নেত্রীকেই আটক করা হয়নি; জাতীয় নেতাদেরও চোখ বেঁধে আটক করা হয়েছিল। সেই শাসনেরও অবসান ঘটেছে। অবসান ঘটেনি শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার।
বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেনাশাসক এরশাদ ও তার দলের ওপর সুদে আসলে নির্যাতন করে জ্বালা মিটিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্য জনসভা থেকে ইতিহাসের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সতীর্থদেরসহ উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। রক্তে ভেসে গেছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। শাসকগোষ্ঠীর অভ্যন্তরে যারা এই ষড়যন্ত্রের, এই নারকীয় গ্রেনেড হামলার নীল নকশা করেছিলেন; তাদের পরিণতি তামাম দুনিয়া দেখছে।
দেশে একটি গ্রহণযোগ্য প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সরকার ও বিরোধী দল সবাই নিতে শুরু করেছেন। রাজনীতিতে আশার আলো জাগতে শুরু করেছে। রমজান মাসের শুরু থেকে সর্বত্র ইফতার মাহফিল ঘিরে রাজনীতি ও সামাজিক মিলনমেলা ঘটছে। প্রতিদিন রাজনীতির কথাবার্তা সব শিবির থেকে আসছে। সিয়াম সাধনা ও সংযমের মাস রমজানে চট্টগ্রামে পাহাড় ধ্বসে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। উদ্ধার অভিযানে যোগ দিতে গিয়ে সেনাবাহিনীর সৈনিক ও কর্মকর্তারাও জীবন দিয়েছেন। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সকল মানুষ পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন। সেখানে বিএনপির মতো একটি বড় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর হামলা আত্নশুদ্ধির এই মাসে সাধারণ সৌজন্যবোধটুকুও রাখা হয়নি।
চট্টগ্রামের মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি ও অথিতিপরায়নতার নজির রয়েছে। সেই নগরীতে একজন ভদ্র, বিনয়ী, পরিশীলিত শিক্ষক থেকে রাজনীতিতে এসেছে সুনাম অর্জন করা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর এই বর্বোরোচিত হামলা মানুষের মধ্যে হতাশাই নয়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও রাজনৈতিক অঙ্গনে আতংকের নবজন্ম দিয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে খতিয়ে দেখা উচিত পরিস্থিতি অশান্ত করার জন্য, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার দিকে টেনে নেয়ার জন্য এই ঘটনার নেপথ্যে কারো ইন্ধন রয়েছে কিনা?
দিনটি ছিল বাবা দিবস। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি উচ্চ শিক্ষিত কন্যার পিতাই নন; তার একটি ছোট্ট নাতিও রয়েছে। মানুষের জন্য রাজনীতি করতে এসে তার মতো ভদ্রলোকের যদি দিন দুপুরে এই ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি পরতে হয়, তাহলে রাজনীতির রুগ্নদশা জটিল রোগে আক্রান্ত হবে। এমনিতেই ভদ্র, সৎ ও বিনয়ী মানুষেরা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। দেশে এখনো অসংখ্য আদর্শিক রাজনীতিবিদদের পদচারণা রয়েছে। যাদের অতীত গৌরবের, যাদের বর্তমান শ্রদ্ধা কুড়ানোর। তাদেরকেও আজ ভাবতে হবে, কি সরকার, কি বিরোধী দল; সকল রাজনীতিবিদদেরই রাজনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে, রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা-সম্মান অর্জন করতে ক্লিন ইমেজের মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর যে হামলা ঘটেছে তার প্রতিকার চাওয়া।
ফখরুলের ওপর হামলা ইতিবাচক, সুস্থ রাজনীতির গতিপথ হাঁটা নেতৃত্বের ওপরই আক্রমণ। এই আক্রমণকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা সময়ের দাবি। মির্জা ফখরুলের ওপর হামলাকারীরা গণতন্ত্রের শত্রু। সুস্থ রাজনীতির জন্য এই হামলাকারীরা অভিশাপ।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন