আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যা বলেন আদালতের রায় প্রশ্নবিদ্ধ : আমির হোসেন আমু। প্রধান বিচারপতি ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন :এলজিআরডি মন্ত্রী। প্রধান বিচারপতির বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করা উচিত : আ. ক. ম মোজাম্মেল বিএনপি নেতৃবৃন্দ যা বলেন খায়রুল হকের অপসারণ ও গ্রেফতার দাবি বিএনপির। আওয়ামী লীগ তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে : ফখরুল। সরকার বিচলিত ও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে : মওদুদ। বিশিষ্টজনের মত কিছু বিষয় অপ্রাসঙ্গিক হলেও প্রধান বিচারপতি ভুল কিছু বলেননি: হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের পর রায় নিয়ে আর রাজনীতি করা উচিত নয় : অধ্যাপক ইমতিয়াজ।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরব গোটা রাজনৈতিক অঙ্গণ। অরাজনৈতিক অঙ্গণেও চলছে এনিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। মোটকথা, দেশের প্রায় সর্বত্র এখন আলোচনার কেন্দ্রে এই বিষয়টি-ই। রায়ে সংক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীরা পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন বিষয় ও প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার প্রকাশ্য সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে এই রায় ও পর্যবেক্ষণে উচ্ছ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে বিএনপিসহ দলটির সমমনাদের বক্তব্য-মন্তব্যে। এনিয়ে তক্কাতক্কির প্রতিযোগিতায় রাজনীতির মাঠ থেকে উধাও হয়ে গেছে অন্য প্রায় সব ইস্যু। বিশেষ করে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা ও নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ করা না করা নিয়েও ক’দিন আগ পর্যন্ত চলা বিতর্ক এখন চাপা পড়েছে ষোড়শের রায় ও পর্যবেক্ষণে।
‘রায় নিয়ে রাজনীতি’ চোখ এড়ায়নি সুপ্রিম কোর্টেরও। যার প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘রায় নিয়ে কেউ রাজনীতি করবেন না, আমরা অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন, আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের ফাঁদে পা দেব না।’ আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে একইদিন সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলেছেন, ‘আমরা রায় নিয়ে রাজনীতি করতে চাই না, রায় ও পর্যবেক্ষণের কিছু বিষয়ে আমরা দুঃখিত ও সংক্ষুব্ধ, তারপরেও রায়ের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল।’ রাজনৈতিকভাবে নয়, সরকার আইনিভাবেই সবকিছু মোকাবেলা করতে চায় বলেও জানান আইনমন্ত্রী।
প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীর বৃহস্পতিবারের এই বক্তব্যের পর রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে কোনো পক্ষেরই আর রাজনীতি করা সমীচীন নয় বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন আহমেদ গতকাল শুক্রবার ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘রায় নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে। কিন্তু এটা নিয়ে কোনো পক্ষেরই রাজনীতি করা ঠিন নয়। প্রধান বিচারপতিকে অপসারণে আন্দোলন করা হবে বলে খাদ্যমন্ত্রী (কামরুল ইসলাম) যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা খারাপ লক্ষণ। আমার কথা হচ্ছে, আদালতের পর্যবেক্ষণে কিছু বিষয় হয়তো মূল ইস্যুর সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক, তবে একথা সত্য যে-প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে কিন্তু ভুল কিছু বলেননি। এটা তো সত্য যে, দেশের কোথাও এখন জবাবদিহিতা ও প্রতিবাদ নেই বললেই চলে।’
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে চলমান রাজনৈতিক বাহাস সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘পুরো বিষয়টি আমরা দেখছি, প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী বৃহস্পতিবার অত্যন্ত গঠনমূলক বক্তব্য রেখেছেন। তাদের দু’জনের এই বক্তব্যের পর এনিয়ে আর কারোই রাজনীতি করা উচিত নয়। আমাদের দেশে অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্যানে এমন কিছু বিষয় সামনে চলে আসে যখন আমরা অনেকেই নিজেদের পেশাদারিত্বটা ভুলে যাই। যার কারণে ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যার ঘটনা ঘটে। কার কোন দায়িত্ব, কে কোন দায়িত্ব নেবে, কোনটি নিয়ে কার কথা বলা উচিত, কার উচিত নয়- এ ব্যাপারে আমরা সতর্ক থাকি না। সবাই যদি যার যার অবস্থানে দায়িত্বশীল হন, তাহলে এই অপচর্চা কমে আসবে।’
আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে গতকালও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা বিভিন্ন স্থানে সমালোচনামূলক বক্তব্য রেখেছেন। পক্ষান্তরে গত কয়েকদিনের মত গতকালও রায়ের পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন বিএনপি নেতারা। সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যের প্রতিবাদ ও তিন দফা দাবিতে সারাদেশে জেলা বারসমূহে রবি, বুধ ও বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বিএনপি সমর্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিপরীত অবস্থানের বাইরে অন্য কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে বিচারবিভাগকে প্রতিপক্ষ না বানানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
খায়রুল হকের অপসারণ ও গ্রেপ্তার দাবি এবং তিনদিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হকের বক্তব্যকে ‘আদালত অবমাননাকর’ দাবি করে তার অপসারণ ও গ্রেপ্তার দাবি করেছে বিএনপি সমর্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। গতকাল রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন এই দাবি জানান। এসময় তিনি দিন দফা দাবিতে সারাদেশে জেলা বারসমূহে আগামী রবি, বুধ ও বৃহস্পতিবার তিনদিনের বিক্ষোভ কর্মসূচিও ঘোষণা করেন। তিন দফা দাবি হচ্ছে- আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে খায়রুল হকের অপসারণ ও গ্রেপ্তার, মন্ত্রীদের বক্তব্যের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা এবং নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরি বিধিমালার গেজেট অবিলম্বে প্রকাশ।
ব্যারিস্টার খোকন বলেন, যারা আইনের শাসনে বিশ্বাস করেন, যারা সংবিধানে বিশ্বাস করেন, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তারা যেন এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বলেন, খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে বলেছেন যে, বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার পরে তাদের কোনো সরকারি দায়িত্ব নেয়া উচিত নয়। তিনি নিজেই নিজের রায় ভঙ্গ করে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন। সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যেসব পদ সাংবিধানিক পদ আছে সেগুলোর শপথের কথা বলা আছে। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের শপথের কোনো বিধান নেই। চেয়ারম্যান প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারি মাত্র। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হিসেবে তার বক্তব্যে সীমাবদ্ধতা আছে, কোড অব কন্ডাক্ট আছে। কোড অব কন্ডাক্ট অনুযায়ী তিনি সংবাদ সম্মেলন করতে পারেন না, তিনি চাকরির শর্ত ভঙ্গ করেছেন।
প্রধান বিচারপতি ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন: এলজিআরডি মন্ত্রী
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি বঙ্গবন্ধুর প্রতি কটাক্ষ করার ‘ধৃষ্টতা’ দেখিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। গতকাল মাদারীপুরে একটি সভায় তিনি বলেন, এ রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ব্যাপকভাবে অসাংবিধানিক ও অনৈতিক কথাবার্তার অবতারনা করেছেন। এমনকি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়েও কটাক্ষ করতে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। আমরা এর ধিক্কার জানাই। আমরা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলতে চাই, যে সমস্ত অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় রায়ে উল্লেখ আছে, তা পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ করছি। এলজিআরডি মন্ত্রী বলেন, যে দেশে বিচার ব্যবস্থায় আস্থার সংকট দেখা দেয়, সে দেশে প্রলয়ংকারী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়।
আওয়ামী লীগ তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে: মির্জা ফখরুল
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আওয়ামী লীগ তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। লন্ডনে চিকিত্সাধীন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আরোগ্য কামনা করে গতকাল বিকালে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক দোয়া মাহফিলে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ফখরুল বলেন, রায় ঘোষণার পরে আওয়ামী লীগ এমন সব মন্তব্য করেছে, যে মন্তব্য শুধু অশালীনই নয়, তা আদালত অবমাননার শামিল। একজন মন্ত্রী যিনি নিজে হাইকোর্ট দ্বারা সাজাপ্রাপ্ত, তার মন্ত্রিত্ব থাকা উচিত নয়, তিনি আবার প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেছেন। খুব চিত্কার করে কথা বলছেন। ওই মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, আগে নিজের মুখের দিকে তাকান।
রায়ে সরকার বিচলিত ও নড়বড়ে: মওদুদ
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের মধ্য দিয়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রায়ে ১৬ কোটি মানুষের দুঃখ-বেদনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ রায়ে সরকার বিচলিত হয়ে গেছে, নড়বড়ে হয়ে গেছে। বিচারপতিরা তাদের বিবেক দিয়ে রায় দিয়েছেন। কারও দিকে তাকিয়ে রায় দেননি। এতদিন আমরা যা বলে এসেছি, এ রায়ের মধ্যে তার প্রতিফলন ঘটেছে। গতকাল মওদুদ আহমদ নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের বাড়ির সামনে মাঠে কবিরহাট উপজেলা, সদর পূর্বাঞ্চল ও কবিরহাট পৌরসভা বিএনপির নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে একথা বলেন।
মওদুদ আরও বলেন, বিচারপতিরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নন, এ রায়ে মধ্যে অনেক বাস্তবমুখী কথা বলা হয়েছে। এই সরকার মানুষকে ভয় পায়, জনগণকে ভয় পায়। কারণ, তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, জনগণ তাদের সঙ্গে নেই।
আদালতের রায় প্রশ্নবিদ্ধ: আমির হোসেন আমু
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, বিশ্বাসঘাতকরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্যদিয়ে বাঙ্গালীর স্বাধীনতাকে হত্যা করেছিল। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে। আদালতের এই রায় প্রশ্নবিদ্ধ। গতকাল ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় তিনি একথা বলেন।
প্রধান বিচারপতির বক্তব্য দুঃখজনক: আ.ক.ম মোজাম্মেল
মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী আ.ক. ম মোজাম্মেল হক গতকাল বেলাব মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স্রের উদ্ভোধন উপলক্ষে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মতবিনিময় উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেছেন, প্রধান বিচারপতির বক্তব্য দুঃখজনক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন