সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের রায় নিয়ে চলমান অস্থিরতার মধ্যেই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে নৈশভোজে যোগ দিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। শনিবার রাতে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে আয়োজিত এ নৈশভোজে অংশ নেন তিনি। নৈশভোজের আগে-পরে এই দুজনের মধ্যে সম্প্রতি বিষয়ে আলোচনা হয় বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
প্রধান বিচারপতি ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের নৈশভোজ আপাতদৃষ্টিতে সামাজিক অনুষ্ঠান মনে হলেও এটি বেশ রাজনৈতিক গুরুত্ববহ। শনিবার সন্ধ্যায় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে যাওয়ার আগে নৈশভোজের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে এ দুজনের মধ্যে ঠিক কী কী বিষয়ে আলাপ হয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুজনের কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সরকারি দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণের কিছু বিষয় নিয়ে ক্ষুব্ধ সরকারি দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ইতোমধ্যে এ বিষয়গুলো আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন মাধ্যমে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতিকে। অপরদিকে প্রধান বিচারপতি নিজেও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং আইন সচিবের নানাবিধ কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ। আইন মন্ত্রণালয়ের যে কোনো প্রজেক্ট গেলেই আইনমন্ত্রী সেটি পাসের ক্ষেত্রে টালবাহানা শুরু করেন, এছাড়াও আইন মন্ত্রণালয়ের কিছু আচরণে মন্ত্রণালয়ের ওপর নিজের নেতিবাচক অবস্থানের কথা প্রধান বিচারপতি তার ঘনিষ্ঠজনদের জানান। সরকারি দলের নেতারা বলেন, দুপক্ষের মধ্যেই কিছু ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ের ভুল বোঝাবুঝির রেশ যেন রাষ্ট্রের ওপর না পড়ে সে জন্য সংকটগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একান্তে আলাপ করতে তার বাসায় নৈশভোজে যোগ দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রায়ের পর্যবেক্ষণের আপত্তিকর অংশগুলো প্রত্যাহারের জন্য এস কে সিনহার সঙ্গে আলোচনা করেন ওবায়দুল কাদের। রাত ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে দুজনের মধ্যে একান্তে বৈঠক হয়। এতে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় সংসদ নিয়ে অবমাননাকর কোনো বক্তব্য তিনি রায়ে লেখেননি। ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায় না পড়ে আংশিক কিছু পড়ে এসব সমালোচনা করা হচ্ছে।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতিবাদে আগামী ১৩, ১৬ ও ১৭ আগস্ট সারা দেশে প্রতিবাদ সমাবেশ করবে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ওই তিন দিন দুপুর ১টায় সারা দেশের আইনজীবী সমিতিগুলোয় প্রতিবাদ সমাবেশ পালিত হবে।
আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি যেসব অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য এবং পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা দেশের আইনজীবী সমাজকে সংক্ষুব্ধ এবং ব্যথিত করেছে। রায়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় সংসদ এবং অধস্তন আদালতের প্রতি রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচন কমিশন নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা বাতিল করে দেওয়া আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশের পর থেকে তা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ চলছে। আওয়ামী লীগ এই রায়ের সমালোচনা করলেও বিএনপি এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে মন্তব্য করেছে।
রায়ে যেসব ‘আপত্তিকর, অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক, অপ্রাসঙ্গিক’ পর্যবেক্ষণ রয়েছে, সেগুলো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা। তারা বলেন, এমন পর্যবেক্ষণ অসাংবিধানিক ব্যক্তিদের ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে। ফলে এসব মতামত-পর্যবেক্ষণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে।
রায় নিয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়াকে সমর্থনও জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ। পরিষদের নেতারা বলেন, দেশের রাজনৈতিক অপশক্তিকে ইস্যু করে দিতে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করার অপচেষ্টা চলছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার গণভবনে আওয়ামী লীগের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের রায়কে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মন্তব্য করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে যৌথসভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লী এবং সম্পাদকম-লীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত নেতারা এসব তথ্য জানান। এই রায়ের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে এবং রায়ের ভুলভ্রান্তি খুঁজে বের করে, অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা।
আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন