আগামী নির্বাচনে সংবিধান ইস্যুতে কোনো ধরনের ছাড় দেবে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেজন্য সংবিধানের বাইরে গিয়ে বিএনপির নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার প্রস্তাবে সাড়া দেয়ার কোনো চিন্তাও নেই দলটির নীতিনির্ধারকদের। ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পথেই হাঁটবে ক্ষমতাসীনেরা। এ ক্ষেত্রে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলো সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।
গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকমণ্ডলীর এক সভায়ও সরকারের এমন অবস্থান ব্যক্ত করেছেন সিনিয়র নেতারা। ওই সভায় আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে নির্বাচন প্রতিযোগিতাপূর্ণ হবে নাÑ এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। নির্বাচন প্রতিযোগিতাপূর্ণ হবে। কারণ, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আর চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলাও চলছে। এই অবস্থায় তারা নির্বাচনে অংশ নেবে কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে দলের দুই শীর্ষ নেতার মামলার কারণে তারা খুব চাপে থাকবে। এ সময় তিনি শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন না বলে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হবে এই বিষয়টার ওপর জোর দিতে বলেন। প্রধানমন্ত্রীও তার এ বক্তব্যে সমর্থন জানান।
এ সময় দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমরা শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে আবার বিজয়ী হবো। কার অধীনে নির্বাচন হবে এটা না বলে আমাদের বলতে হবে নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। সেখানে নির্বাচন পদ্ধতি স্পষ্ট করাই আছে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।’
সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো জানায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপিকে নানাভাবে চাপে রাখার যে মনোভাব ছিল সরকারি দলে, সেটা এখনো আছে। ওই নির্বাচনের আগে সরকারের পরিকল্পনার বিপরীতে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলোর সামনে আন্দোলনসহ অন্য বিকল্প পথও ছিল। কিন্তু আগামী নির্বাচনের আগে বিএনপিকে অন্য বিকল্প নিয়ে ভাবারও সুযোগ দেবে না সরকার। বিশেষ করে আাগামী নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপির রাজনীতি দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের মামলাকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খাবে। নির্বাচনের আগে এ থেকে কোনোভাবেই তাদের বের হতে দেবে না সরকার। ফলে বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকার কিংবা সরকারবিরোধী কোনো ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করতে পারবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
এ ছাড়া ক্ষমতাসীনরা আরো মনে করছেন, পরপর দু’বার জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার মতো আইনি জটিলতায় পড়তে পারে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক সব বাস্তবতা মেনে নির্বাচনে অংশ নেয়া ছাড়া বিএনপির সামনে বিকল্পও থাকবে না। ফলে বর্তমান সংবিধান মেনে শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার অধীনেই বিএনপি নির্বাচনে যেতে বাধ্য হবে।
শাসকদলের সূত্রগুলো জানায়, ২০১৪ সালের নির্বাচনে যেমন বলা হয়েছিল সংবিধানের বাইরে একচুলও যাওয়া যাবে না। এবারো ঠিক একই পথে থাকবে ক্ষমতাসীনেরা। এ ক্ষেত্রে একচুলের কম কোনো পরিমাপ থাকলে সে পরিমাণও ছাড় দেয়া হবে না। কারণ ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি সংসদের বিরোধীদল ছিল, তাই তাদের সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এবার সাংবিধানিকভাবে সে সুযোগ নেই। আর যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণাটিই নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপর ভিত্তি করে; তাই সেখানে অনির্বাচিত কাউকে নেয়ার সুযোগ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের তিনজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, নির্বাচনের আগে সংবিধানের কোনো বিষয়ে ছাড় দিলে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে ভুল বার্তা যাবে। এতে নির্বাচনের আগেই একধাপ এগিয়ে যেতে পারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি জোট। তাতে হতাশ ও ভেঙে পড়তে পারেন মাঠের নেতাকর্মীরা, যা নির্বাচনে নেতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারে। তাই নির্বাচনের আগে কোনো বিষয়ে সরকারের অবস্থানের পরাজয় চাচ্ছে না ক্ষমতাসীনেরা।
আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো আরো জানায়, সরকারের দমন-পীড়ন ও হামলা-মামলায় জর্জরিত বিএনপি খুব নাজুক অবস্থায় রয়েছে। কোনো ইস্যুতেই তারা সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। আর রাজপথ দখলের সামর্থ্য না থাকায় বিএনপি এখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার শরণাপন্ন হয়ে পড়ছে। তাই শুধু বিএনপি নয়; অন্য কোনো সংগঠনও যেন রাজপথ উত্তপ্ত করতে না পারে সে ব্যাপারে বেশ সতর্ক সরকার। তাই রাজপথে যেকোনো সামাজিক আন্দোলন এবং বিতর্কিত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
সরকার ও আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, তাদের কাছে আপাতত স্বস্তির বিষয় হচ্ছে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপি বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারেনি। মুখে সমালোচনা করলেও বিএনপি নতুন নির্বাচন কমিশনকে মেনে নিতে অনেকটা বাধ্য হয়েছে। সামনে হয়তো নির্বাচনকালীন বিশেষ সরকারের জন্য বিএনপি আরো সোচ্চার হবে। তবে আওয়ামী লীগ ও সরকার এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবে না। জ্বালাও-পোড়াওসহ রাজপথে যেকোনো আন্দোলন দমনে সরকার বেশ সজাগ রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে দলের দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলো তাদের সম্ভাব্য আন্দোলন দমনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এক দিকে আন্দোলন অন্য দিকে মামলার অগ্রগতি এবং রায় সামনে চলে এলে মামলা নিয়েই তাদের ব্যস্ত থাকতে হবে। অবশেষে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে সরকারের ছক মেনেই আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপি বাধ্য হবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন।
তবে আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে বিএনপিকে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই আগামী অংশ নিতে হবে। অবস্থা এমন দাঁড়াবে যে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বাইরে তাদের কোনো বিকল্প থাকবে না।
তবে সরকার পরিচালনা ও রাজনীতিতে নানা উত্থান-পতন আসতে পারে। এ ছাড়া রাজনীতিতে শেষ কথা বলেও কিছু নেই। তাই সব কিছু নির্ভর করবে সরকারবিরোধীদের আন্দোলন এবং সরকারের দমন কৌশলের ওপর। এ ক্ষেত্রে যারাই সফল হবে পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে যেতে বাধ্য।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমরা চাই সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। তবে এ ক্ষেত্রে সংবিধান মেনেই তাদের নির্বাচনে আসতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় আমাদের দেশেও সেভাবেই আগামী নির্বাচন হবে। এর বাইরে কেউ কিছু চিন্তা করলে তারা অন্ধকারে রয়েছে। সরকার সংবিধান ইস্যুতে কোনো কিছুতেই ছাড় দেবে না। আর সংবিধান না মেনে কেউ নির্বাচন বর্জন করলে সেই অধিকার তো তাদের রয়েছেই। তাদের জন্য তো আর নির্বাচন কমিশন বসে থাকবে না।’
দলের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সংবিধানের বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ নেই। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে যত রকমের সহযোগিতা দরকার, তা প্রদান করবে সরকার। এর পরও কেউ চাইলে নির্বাচনে অংশ না-ও নিতে পারেন, সেই স্বাধীনতা তাদের রয়েছে। কিন্তু সংবিধান ও নির্বাচন নিয়ম অনুযায়ী আপন গতিতেই চলবে। কারো জন্য বসে থাকবে না।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন