মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের আপিলের সারসংক্ষেপ ২৪ আগস্টের মধ্যে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
একই সঙ্গে দু’টি আপিল শুনানির জন্য ১০ অক্টোবর তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
রোববার (১৩ আগস্ট) সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে তিন বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
অন্য দুই বিচারপতি হচ্ছেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
আদালতে আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহাবুবে আলম।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর জেলা আলবদর বাহিনীর কমান্ডার এ টি এম আজহারুল ইসলামকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ৩০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একাত্তরে রংপুর অঞ্চলে ১ হাজার ২৫৬ জনকে গণহত্যা-হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণ, ১৩ জনকে আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং শত শত বাড়ি-ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো ৯ ধরনের ৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে পাঁচটি এবং পরিকল্পনা-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি (উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) প্রমাণিত হয় তার বিরুদ্ধে।
এর এক সপ্তাহ আগে ২৩ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার ও শান্তি কমিটির সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে সর্বোচ্চ সাজাসহ ২২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। একাত্তরে ১৫২ জনকে হত্যা-গণহত্যা, ২ নারীকে ধর্ষণ, ৫ জনকে আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় এবং দুই শতাধিক বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন এবং ষড়যন্ত্রের ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে ১৪টিই প্রমাণিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে প্রথমবারের মতো অন্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের দায়ে ফাঁসির আদেশ পান কায়সার। সাঁওতাল নারী হীরামনি ও অপর নারী মাজেদাকে ধর্ষণের অপরাধ দু’টি প্রমাণিত হয় রায়ে। ওই দুই বীরাঙ্গনা নারী ও ধর্ষণের ফলে বীরাঙ্গনা মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহার প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্যও দেন কায়সারের বিরুদ্ধে। রায়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত বীরাঙ্গনা নারী ও যুদ্ধশিশুদের ক্ষতিপূরণ স্কিম চালুর পাশাপাশি তালিকা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে বলেন ট্রাইব্যুনাল।
অন্যদিকে এক নারীকে ধর্ষণ ও পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণে সহায়তার দায়ে ২৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পান আজহার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর টাউন হলে স্থাপিত পাকিস্তানি ও রাজাকার ক্যাম্পে আজহারের নেতৃত্বে ধর্ষণ ও নির্মম নির্যাতনের শিকার হন ওই নারী। আজহারের বিরুদ্ধে ওই বীরাঙ্গনা রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী হিসেবে ক্যামেরা ট্রায়ালে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। রায়ে তাকে পুনর্বাসন করতে রাষ্ট্রকে বলেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের আত্মত্যাগ তুলে ধরতে পাঠ্যপুস্তকে বীরাঙ্গনাদের বিষয়টি তুলে ধরতে বলা হয়।
২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল (নং: ১২/২০১৫) করেন এ টি এম আজহার। ৯০ পৃষ্ঠার মূল আপিলসহ ২ হাজার ৩৪০ পৃষ্ঠার আপিলে ১১৩ যুক্তিতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ফাঁসির রায় বাতিল ও খালাস চেয়েছেন তিনি।
এর ৯ দিন আগে ১৯ জানুয়ারি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ফাঁসির সাজা বাতিল ও বেকসুর খালাসের আরজি জানিয়ে আপিল করেন (নং: ০৪/২০১৫) কায়সার। ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিলের পক্ষে মোট ৫৬টি যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি।
আসামিপক্ষে আপিল মামলা দু’টিরই অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নাল আবেদিন তুহিন ও শুনানিতে নেতৃত্ব দেবেন অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে নেতৃত্ব দেবেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
আজহারের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের মোট ১৫৮ পৃষ্ঠার রায়ে বলা হয়েছে, রংপুরের কারমাইকেল কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে আজহার জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের রংপুর শাখার সভাপতি ও ওই জেলার আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। রংপুর ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াতের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। আসামি আজহার মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের স্বজন, মুক্তিকামী বাঙালি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে দিতেন এবং তাদের হত্যা, গণহত্যা, আটক ও নির্যাতনে পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র করে তা বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকতেন।
অন্যদিকে কায়সারের বিরুদ্ধে ৪৮৪ পৃষ্ঠার রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, একাত্তরে সৈয়দ কায়সার প্রথমে হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ৫০০/৭০০ স্বাধীনতাবিরোধী লোক নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করতে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ নামে বাহিনী গঠন করেন। তিনি নিজে ওই বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ‘কায়সার বাহিনী’ নামাঙ্কিত এ বাহিনীর নিজস্ব ইউনিফরমও ছিল।
কায়সার এ বাহিনীর মাধ্যমে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর কুমিল্লায় হত্যা, গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, ধর্ষণ, হামলা, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। তিনি পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালান।
রায়ের পর্যবেক্ষণে কায়সার বাহিনীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী বা অক্সিলারি ফোর্স না বললেও ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ বাহিনী ও সৈয়দ কায়সার ভিক্টিম ও অপরাধ সংঘটনস্থল এলাকাগুলোর মানুষের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকবেন।
ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দেওয়ায় যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহারকে সাহসিকতার জন্য এবং সকল নির্যাতিত নারী ও বীরাঙ্গনাদের স্যালুট জানান ট্রাইব্যুনাল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন