সংবিধান প্রণেতা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ড. কামাল হোসেন মনে করেন, সংবিধানের ষোড়শ সংবিধানের রায় নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য অন্ধ দালালরাই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরি করছে। রোববার বিকালে রাজধানীর মতিঝিলে নিজ চেম্বারে পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল নিয়ে আদালতপাড়া থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন এখন দুই শিবিরে বিভক্ত। চলছে নানা বিতর্ক। আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। এর পরিণতি কি এবং শেষ কোথায়? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত রায় প্রকাশ হয়েছে। আমি দীর্ঘ এ রায়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি কয়েকবার। এটা নিয়ে কোনো বিভক্তির সুযোগ নেই। বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করছে। এখানে মুখোমুখি হওয়ার কিছু নেই। এখানে পরিণতিরও কিছু দেখছি না।
বাহাত্তরের সংবিধানে আপনারাই বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে রেখেছিলেন। সেই সংবিধানের প্রণেতা হিসাবে আপনি কেন সেটা সংসদের হাতে না রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে ড. কামাল হোসেন বলেন, আজকের প্রেক্ষাপট আর বাহাত্তরের প্রেক্ষাপট এক নয়। দুনিয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও অনেকদূর এগিয়েছে। বর্তমান সংসদ এবং এমপিদের সঙ্গে বাহাত্তরের এমপিদের কোনো তুলনা হতে পারে না। বর্তমান কোনো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রায় গেলেই তারা সেই বিচারপতিকে অপসারণ করতে চাইতে পারেন এমনকি বিচারকরাও কোনো এমপির বিরুদ্ধে রায় দিতে চিন্তা করবে। এ অবস্থায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী যে বাতিল হয়েছে তা একটি বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত বলেই মনে করি।
সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে কেন বিরোধ হয়? আমাদের বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংবিধানের ১১১, ১১২ অনুচ্ছেদ সর্বোচ্চ আদালতকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে, তারা বিচার-বিশ্লেষণ করে যে রায় দেবেন- তাই চূড়ান্ত। তাছাড়া সর্বোচ্চ আদালতের ৭ জন বিচারকই সর্বসম্মতভাবে এই রায় দিয়েছেন। তা নিয়ে বিতর্ক করা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল। আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছেই বলেই এ রায় দিতে পেরেছে।
সংবিধান লঙ্ঘন করার পরিণতি কখনও ভালো হয় না বলে ড. কামাল হোসেন বলেন, যদি বুঝতাম যে কেউ ভিন্নমত পোষণ করেছেন, তাহলেও কথা ছিল। এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যে সভা-সমাবেশ হচ্ছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত, সংবিধানের অবমাননা। এক প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল বলেন, সর্বসম্মতিক্রমে রায় পেয়েছি। এ রায়ের মধ্যদিয়ে বিতর্কের অবসান হয়েছে। এ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করা মোটেও সমীচীন নয়।
তিনি বলেন, সমালোচনাকারীরা জাতীয় জাদুঘরে যেতে পারেন, গিয়ে দেখতে পারেন বঙ্গবন্ধু কি লিখে দিয়ে গেছেন? সংবিধানের ৭ম অনুচ্ছেদই হচ্ছে আমাদের রক্ষাকবচ, গাইডলাইন। এতে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ- কেবলই সংবিধানের অধীন এবং কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। এরপরেও কেন আমরা বিতর্ক করছি বুঝতে পারি না। পক্ষে গেলে ঠিক আছে, বিপক্ষে গেলে মানি না- এই মনোভাবের অবসান হওয়া জরুরি।
ড. কামাল আরো বলেন, পুরো রায়টি পড়েছি। কোথাও বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা হয়নি। তার কোনো অবমূল্যায়ন করা হয়নি। অপব্যাখ্যা দিয়ে বিষয়টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে। সত্যিকার অর্থেই এটা দুঃখজনক। দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়েছে এমন ব্যাখ্যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেন, রায়ের মধ্যদিয়ে এটা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, যদিও কেউ মানছেন, কেউ মানছেন না। না মানাটা সংবিধান পরিপন্থি, বলতে পারেন বরখেলাপ। সংবিধান মানলে ১১১ অনুচ্ছেদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে সুপ্রিম কোর্টের দেয়া রায় নিয়ে বিতর্ক করার সুযোগ কোথায়? ১১২ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত সকল নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তা করবেন।
আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কি দেখছেন এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশের প্রতিটি মানুষই সুষ্ঠু গণতন্ত্র পেতে চায়। দেশের মানুষ যেন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সেটি সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবশ্যই ভালো মনে করি। আশা করছি রাজনীতিতে সহমর্মিতার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ একটি ভোট হবে।
দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের বাইরে একটি বিকল্প রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে? বিষয়টাকে কিভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের জোট গঠন অন্যায় কিছু নয়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে রয়েছে। এখানে বিকল্প জোট জনগণের আশা আকাঙ্খা পূরণে কাজ করবে বলেও আমি বিশ্বাস করি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন