দেশ কাঁপানো সিরিজ বোমা হামলার ১২তম বার্ষিকী আজ। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলার (মুন্সীগঞ্জ ছাড়া) পাঁচ শতাধিক স্থানে একযোগে বোমা হামলা চালায় জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)।
এ সিরিজ হামলার এক যুুগ পার হলেও বিচার শেষ হয়নি ৫৮টি মামলার। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনিটরিং না থাকার সুযোগে আদালত থেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে তিন শতাধিক জঙ্গি।
এসব জঙ্গির মধ্যে জেএমএবির সক্রিয় সদস্য ও সিরিজ বোমা হামলা মামলার চার্জশিটভুক্ত ১৯২ সদস্য রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জামিনে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের মধ্যে ২০ জন দুর্ধর্ষ জঙ্গি রয়েছে। পলাতক এসব দুর্ধর্ষ জঙ্গি ধরতে একের পর এক পুরস্কার ঘোষণা করা হলেও তাদের হদিস মিলছে না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, জামিন নিয়ে পালিয়ে থাকা জঙ্গিরা আবার সংগঠিত হয়ে নব্য জেএমবির (নিউ জেএমবি) জন্ম দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তারা নাশকতা চালাচ্ছে। গ্রেফতারের পর পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে যাওয়া দুর্ধর্ষ জঙ্গি জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানের এখনও খোঁজ মেলেনি। এমনকি পলাতকরা কে কোথায়- এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই কারও কাছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার খোদ রাজধানীতে জাতীয় শোক দিবসের (১৫ আগস্ট) অনুষ্ঠানে হামলার মাধ্যমে ব্যাপক প্রাণহানির পরিকল্পনা করেছিল নব্য জেএমবি। দেশে জঙ্গি অপতৎপরতা দমনে কাজ করছেন এমন একজন কর্মকর্তা মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, একের পর এক অভিযানে প্রায় নেতৃত্বশূন্য সংগঠনের সদস্যদের মনোবল চাঙ্গা এবং নতুন সদস্য সংগ্রহের টার্গেট নিয়ে এ হামলার পরিকল্পনা ছিল সংগঠনটির। জাতীয় শোক দিবসের মূল অনুষ্ঠানস্থল ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের কয়েকশ’ গজ দূরে ভয়াবহ বিস্ফোরক নিয়ে অবস্থান নিয়েছিল জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যরা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় ভয়াবহ ওই নাশকতার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে রাজধানীবাসী। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিরিজ বোমা হামলায় গ্রেফতারের পর জামিন নিয়ে পলাতক হল- ফারুক, শফিক, মিলন, সবুজ, সাজেদুর, মানিক, মাজিদ, কফিল উদ্দিন ওরফে রব মুন্সী, আজিবুল ইসলাম ওরফে আজিজুল, শাহান শাহ, হামিদুর রহমান, বজলুর রহমান, বাবর, শরিফ, খাইরুল ইসলাম, নাদিম, ময়েজ উদ্দিন, মহব্বত ওরফে তিতুমীর ওরফে নাহিদ এবং ওয়ালিউল্লাহ ওরফে হামিদ। বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্ধারিত দিনে সাক্ষীদের হাজির না হওয়াকে দায়ী করেন ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এসব মামলায় যাদের সাক্ষী করা হয়েছিল তাদের এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি যেসব মামলায় পুলিশ সাক্ষী রয়েছেন তারাও নির্ধারিত দিনে হাজির হন না। এমনকি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেও দিনের পর দিন সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না। এর ফলে মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া এক প্রকার ঝুলে রয়েছে।
পুলিশ সদর দফতর জানায়, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সকালে মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যবধানে দেশের পাঁচ শতাধিক স্থানে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় দুইজন নিহত ও চার শতাধিক নারী-পুরুষ আহত হন। বোমা হামলার পাশাপাশি জেএমবি সদস্যরা সারা দেশে লিফলেটের মাধ্যমে তাদের মতাদর্শ প্রচার করে। গোয়েন্দারা মনে করেন, ওই ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেশি না হলেও এটি ছিল জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ড্রেস রিহার্সেল। এদিকে সিরিজ বোমা হামলার পর পুলিশ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে সারা দেশে ১৬১টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় ৬৬০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মামলাগুলো তদন্ত শেষে পুলিশ ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট আদালতে ১৩৬টি চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেছে। একই সঙ্গে এজাহারভুক্ত ৬৬০ জনের মধ্যে ৪৫৫ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে। তবে চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে ইতিমধ্যে ১৯২ জন জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে। ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে দুর্ধর্ষ জঙ্গি জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজান ও সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীনকে ছিনিয়ে নেয় সহযোগীরা। হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এবং বিচারাধীন ১৮ মামলার আসামি বোমারু মিজানের বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহে। গোয়েন্দারা জানান, মিজানের তৈরি বোমা দিয়ে ২০০৫ সালে সারা দেশে হামলা চালানো হয়েছিল। তেজগাঁও পলিটেকনিকের ছাত্র বোমারু মিজান বর্তমানে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে এবং সেখানে বসে কলকাঠি নাড়ছে বলে তথ্য গোয়েন্দাদের।
জামিন নিয়ে পলাতক আরেক জঙ্গি সাফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরানের বাড়ি সিলেট অঞ্চলে। সিরিজ বোমা হামলার পর ২০০৯ সালে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তিন বছর পর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জামিন নিয়ে লাপাত্তা হয় ইমরান। জামিন নিয়ে পালিয়ে যাওয়া আরেক দুর্ধর্ষ জঙ্গি হল আবুদস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সালমান। কুমিল্লার দেবিদ্বারের আবদুর রশিদের ছেলে সামাদ ২০০৭ সালে গ্রেফতার হলেও মাত্র দেড় বছরের মাথায় জামিন নিয়ে পালিয়ে যায়। সিরিজ বোমা হামলার এজাহারভুক্ত আসামি শিহাব ওরফে সুমন ওরফে সাইফুল গ্রেফতার হয় ২০০৬ সালে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা রফিকুলের ছেলে শিহাব জামিন নিয়ে পালিয়ে যায়। আসামি সাজ্জাদ ওরফে সজীব ওরফে সিয়াম ওরফে শামস গ্রেফতারের ৫ বছর পর ২০১১ সালের মার্চে জামিন পায়। এখনও তার হদিস নেই। সিরিজ বোমা হামলায় যশোরের কোতোয়ালি থানার মামলায় ২০০৬ সালে গ্রেফতার মেহেরপুরের মতিয়ার রহমান ওরফে মাসুদ এবং সাতক্ষীরার মিন্টু ওরফে রুহুল কুদ্দুস ওরফে খালিদ হোসেন এক বছরেরও কম সময়ে জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছে। ২০০৯ সালের ২৭ এপ্রিল একই মামলায় জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছে ভোলার ফয়সাল মোস্তফা, ইউনুস শরীফ ও মিজানুর রহমান। এছাড়া ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের এক মামলায় নারায়ণগঞ্জের আবদুল্লাহ ওরফে শিবলু ওরফে সায়েদও জামিন নিয়ে পালিয়ে রয়েছে।
অন্যদিকে অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় পুলিশ ২৫টি মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট (চূড়ান্ত রিপোর্ট) দাখিল করেছে। এদিকে তদন্তকালে পুলিশ এজাহারভুক্ত ৪৫৫ আসামিসহ সন্দেহভাজন আরও এক হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। সব মিলিয়ে সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলার মামলাগুলোতে গ্রেফতার আসামির সংখ্যা ছিল দেড় হাজারেরও বেশি। তবে গ্রেফতার তো দূরের কথা, দীর্ঘ এক যুগেও সিরিজ বোমা হামলায় এজাহারভুক্ত ৫৩ আসামির কোনো সন্ধান পায়নি পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তদন্ত শেষে চার্জশিট দাখিলের (১৩৬টি) পর ইতিমধ্যে ১০২টি মামলার বিচার শেষ হয়েছে। এসব মামলায় ৩৫ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড, ১৩১ জনকে যাবজ্জীবন ও ১৮৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। আর অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় ১১৮ জনকে অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়। এদিকে জেএমবির সিরিজ বোমা হামলাসহ অন্য জঙ্গি হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ রাতে শীর্ষ জঙ্গি নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম, খালেদ সাইফুল্লাহ, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হাসান আল মামুনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর জঙ্গি আসাদুর রহমান আরিফ র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। ওই ছয় জঙ্গির পর আর কারও ফাঁসি কার্যকর হয়নি। উচ্চ আদালতে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকি ৩৯ আসামির দণ্ড দীর্ঘদিনেও কার্যকর হয়নি।
জানা যায়, ঢাকার নিন্ম আদালতগুলোতে বিচারাধীন এসব মামলার মধ্যে পাঁচটির কার্যক্রম অনেকটা স্থবির। এসব মামলায় ২৫৬ জন সাধারণ সাক্ষীর বিরুদ্ধে আদালত জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। মামলাগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ে সাক্ষী হিসেবে থাকা ১৫০ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধেও জারি রয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। সিরিজ বোমা হামলার সাক্ষী এসব পুলিশ সদস্য আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন না। আবার সাধারণ (পাবলিক) সাক্ষীদেরও হাজির করছেন না। এসব মামলায় বারবার সময় আবেদন করে অনেকটা দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালন করছেন সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তারা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন