ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। আগামী একাদশ নির্বাচন, নির্বাচনের রোডম্যাপ, নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাসহ দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রায় সব ইস্যুই এখন চাপা পড়ে গেছে ষোড়শ সংশোধনীর বাতিলের রায়কে কেন্দ্র করে চলমান আলোচনা-সমালোচনায়। রায়কে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বধীন ২০ দলীয় জোটসহ ক্ষমতাসীন জোটের বাইরে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধানেরা। আর এ রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল।
গত ১ আগস্ট মঙ্গলবার উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিসংশন সংক্রান্ত ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত রেখে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর প্রায় এক সপ্তাহখানেক তেমন কথাবার্তা না হলেও সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকেই সরকারের মন্ত্রীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ রায়ের সমালোচনা করে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে শুরু করেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা এই রায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। এদিকে এ রায়ের জন্য প্রধান বিচারপতিসহ সংশ্লিষ্টদের সাধুবাদ জানিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের পাল্টা সমালোচনা করছেন বিএনপি ও ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর নেতারা।
এমতাবস্থায় ১২ আগস্ট দিবাগত রাতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে দেখা করতে তার বাসভবনে গিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সেসময় তাদের মধ্যে দুই ঘণ্টা বৈঠক হয় এবং বৈঠক শেষে তারা একসাথে রাতের খাবার খান বলে সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা আবু নাসের। তবে বৈঠকে সেতুমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির মধ্যে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তা সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
তবে এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ১৩ আগস্ট নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, গতকাল রাতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বাসায় গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এতে বিএনপি বিস্মিত, উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত হয়েছে।
গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে সরকার নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের নেতারা প্রধান বিচারপতি এবং বিচার বিভাগ সম্পর্কে যেভাবে কথা বলছেন, তা রাজনৈতিক ভাষা নয়। এটা সন্ত্রাসের ভাষা।
বিচার বিভাগের ওপর চাপ প্রয়োগ না করে তিনি বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার আহ্বান জানান।
১২ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সমাবেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, এত দিন আন্দোলনের ডাক দিয়ে টিভি সিরিয়াল দেখে যাদের সময় কাটত, তারা এখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আনন্দে মাতোয়ারা। যেন আদালত তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। যেমন এত দিন বিদেশিদের কাছে নালিশ করেছে যেন বিদেশিরা বসিয়ে দেবে।
১১ আগস্ট শুক্রবার দুপুরে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ। তিনি বলেন, ‘রায়ে ১৬ কোটি মানুষের দুঃখ-বেদনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ রায়ে সরকার বিচলিত হয়ে গেছে, নড়বড়ে হয়ে গেছে।’
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের মধ্য দিয়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শনিবার বিকেলে চট্টগ্রাম জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, প্রধান বিচারপতি সংবিধান মেনে চলবেন এবং কোনো রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করবেন না বলে শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে এই মামলায় যারা পক্ষ নন, তাদের পক্ষ বানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। নির্বাচন কমিশনকে প্রতিপক্ষ বানিয়েছেন।
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর গুলিস্তানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) কার্যালয়ে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না সরকারকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘বিচার বিভাগকে প্রতিপক্ষ বানাবেন না। প্রতিপক্ষ বানালে আপনাদের লাভ হবে না। দেশেরও ক্ষতি হবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে বড় আশা-ভরসার স্থল সুপ্রিম কোর্ট ও তাঁর আপিল বিভাগকে আওয়ামী লীগ ধমক দিচ্ছে। মন্ত্রীরা বলছেন, প্রধান বিচারপতিকে অক্টোবরের মধ্যে যেতে হবে। না হলে প্রধান বিচারপতিকে বিদায় করে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’
এদিকে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান এক সমাবেশে বলেছেন, আমি আগেই বলেছিলাম ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। বিচার বিভাগ থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। জনগণ আবার নতুন করে গান গাচ্ছে ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা।
বক্তব্যে শামীম ওসমান বলেন, ‘যারা ভাবছেন বাংলাদেশটা পাকিস্তান; যারা ভাবছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা, যার শরীরে জাতির পিতার রক্ত, সেই শেখ হাসিনা নওয়াজ শরিফ; যারা ভাবছেন বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের নাগরিক; যারা ভাবেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, বাংলাদেশের পুলিশ-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাকিস্তানের বাহিনী; তারা বোকার রাজ্যে বাস করছেন। বাংলাদেশ পাকিস্তান না, আর শেখ হাসিনাও নওয়াজ শরিফ না।’
আর এভাবেই ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে ঘিরে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে নয়, আইনিভাবে মোকাবেলা করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
১০ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘রায়ে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতি যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তাতে আমরা বিস্মিত হয়েছি। আমরা ধন্যবাদ জানাই চার বিচারপতিকে। তারা এ পর্যবেক্ষণে একমত হতে পারেননি।’
আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রধান বিচারপতির রায়ে যেসব আপত্তি ও অসংগতি রয়েছে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগ নিব বলেও জানান তিনি।
একইদিন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আমি অনুরোধ করব, আপনারা সংযত আচরণ করবেন, যা সবার জন্য মঙ্গল। সরকার বা বিরোধী দল—কারও ট্র্যাপে পড়ব না। আমরা সচেতন। সাতজন বিচারপতি চিন্তাভাবনা করে রায় দিয়েছি। রায় নিয়ে কেউ পলিটিকস করবেন না।’
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে (১৯৭২) উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত ছিল। এরপর ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর পর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এরপর ২০১৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ঐ বছরের ৫ই নভেম্বর হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন ৯জন আইনজীবী।
প্রাথমিক শুনানির পর হাই কোর্ট ২০১৪ সালের ৯ই নভেম্বর রুল দেয়। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। পরে ২০১৬ সালের ৫ই মে হাই কোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে গত ৪ জানুয়ারি আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। আপিলের ওপর গত ৮ মে শুনানি শুরু হয়, যা ১১তম দিনে গত ১ জুন শেষ হয়।
ওই দিন আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। গত ৩ জুলাই রায়ের সংক্ষিপ্তসার ঘোষণায় রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার প্রিয়.কম-কে বলেন, ‘আজকে বিচার বিভাগ, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে ঘিরে যে তর্ক-বিতর্ক চলছে, এটা আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখছি।’
এমন আলোচনা-সমালোচনায় একটা বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে যে দেশে, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারছে, নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে তুলে ধরতে পারছে, এটা একটা দেশের জন্য ভালো, গণতন্ত্রের জন্য ভালো। তবে সব পক্ষই কিছু কিছু অপ্রীতিকর-অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ ব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
‘জনপ্রতিনিধিরা সবার উপরে’ মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সংসদে আইন প্রণয়ন করেন। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। সব বিভাগেরই সংবিধান অনুযায়ী জবাবদিহিতার নিশ্চিত করা হয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার মূল উৎস হলো জনগণ, আর এটাই গণতন্ত্র।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগের কেউ জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হন না। পাকিস্তানে দেখা যায় বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে বার বার হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এটা ঠিক জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতি স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগ থাকে। জনগণ চাইলে সেটা পরবর্তী নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে জবাব দিতে পারেন। জনপ্রতিনিধিদের কথা যদি বাদও দেই দেশের সব বিভাগের বিরুদ্ধেই কম-বেশি দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু অপকর্মের জন্য সবসময় জনপ্রতিনিধিদের দিকে বন্দুক তাক করে রেখে অন্য কাউকে আরও বেশি ক্ষমতাবান করাটা দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য শুভকর নয়।
প্রচলিত সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে বর্তমান সঙ্কটের সমাধান হবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সংবিধানে অনেক ধারা, উপধারা, আইন রয়েছে। বিচার বিভাগকে সংবিধানের অভিভাবক বলা হয়। আইন থাকা বড় কথা না, আইনের কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে, সেটাই বড় কথা।’
‘আমাদেরকে এগুতে হলে সংসদীয় ব্যবস্থাকে আদর্শ পথে রাখতে হবে, বাংলাদেশে কোনো সুপারম্যান দরকার নাই, সংবিধান অনুযায়ী গণতান্ত্রিক পন্থায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আর এখন দেশে যা হচ্ছে এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, আমাদের মতো পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোকেও এ ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ৪৫ বছরের বয়সে এসব দেশ আজ যে অবস্থানে, এসব প্রক্রিয়ার মাধ্য দিয়ে আইন, বিচার ও শাসন সবগুলো বিভাগেই আরও পরিপক্ক হবে। আরও বেশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে’, বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন