২৪ আগস্ট মায়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরুর পর এ নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বে কম রাজনীতি হয়নি। বিশ্বের বড় বড় মানবতাবাদীরা সজাগ থেকেও ঘুমের বাহানা করেছেন। কিন্তু দরজায় কড়াঘাত এতো বেশি বিকট যে তারা ঘুমের বাহানা করেও নীরব থাকতে পারেনি। অবশেষে রাখাইনের নারকীয় সহিংসতাকে গণহত্যা বলতে বাধ্য হয়েছে।
বহুকাল ধরে নিজ দেশে পরবাসী এবং নিপীড়িত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য এটা একেবারে কম প্রাপ্তি নয়। কেননা, এর আগে বছরে কয়েকবার গণহত্যা চালালেও সেটাকে মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সহিংসতা বলেই চুপচাপ থেকেছেন বিশ্ব নেতারা। কিন্তু এবার সেটা হয়নি, কারণ একবিংশ শতাব্দীতে এ যাবৎকালের সব গণহত্যাকে হার মানিয়েছে এই গণহত্যা।
এক্ষেত্রে আমাদের রাজনীতিবিদদের রাজনীতিকে অনেকে নেতিবাচক হিসেবে দেখার চেষ্টা করছেন। অনেকে তাদের দোষারোপ করছেন নানা বিষয় নিয়ে। কিন্তু আমি বলবো- রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের রাজনীতিবিদরা যা করেছেন ইতিহাসে বিরল। রাজনীতিবিদরা সব সময় সব বিষয় নিয়েই রাজনীতি করবেন, সরকার ও বিরোধী দলের ভূমিকা এবং বক্তব্যে অমিল থাকবে এটাই স্বাভাবিক, এটাই গণতন্ত্র। আর এটা না থাকলে রাষ্ট্র ও সমাজ তার বিশেষ বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলে।
আমরা কী দেখলাম- ২৪ আগস্ট মায়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরুর পর লন্ডন সফররত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে সরকার এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান।
খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা বসতবাটি, সহায় সম্বল হারিয়ে প্রাণ ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার জন্য বাংলাদেশের সীমান্তগুলোতে ভিড় জমাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে গ্রামের পর গ্রামে আগুন জ্বলছে।আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের ওপরও মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী অবিরাম গুলি বর্ষণ করে যে নারকীয় পরিবেশ তৈরি করেছে তা বর্ণনাতীত।ফলে মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে হলেও তাদের আশ্রয় দেয়া উচিত’।
যদিও প্রথমদিকে আমাদের সরকারপক্ষের রাজনীতি অনেকটাই কমপ্লিকেটেড ছিল। আর তা হওয়াটাও স্বাভাবিক, তবে সেটা দোষের কিছু নয়। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ দেশের সব রাজনৈতিক দল এ ইস্যুতে কণ্ঠ উচ্চকিত করেছে। এ ইস্যুতে রাজনীতিতে নদীর জল অনেক ঘোলা হয়েছে, বিশেষ করে আওয়ামী ও বিএনপির মধ্যে অনেক বাকযুদ্ধ হয়েছে। অবশেষে আমরা কী দেখলাম- দু’পক্ষই সঠিক অবস্থান নিয়েছে। এখন সবাই রোহিঙ্গাদের সহায়তায় এগিয়ে যাচ্ছেন। এমন কী বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও সক্ষম হয়েছেন। আজ জাতিসংঘ, ওআইসিসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ এগিয়ে এসেছেন। রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করছেন, রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বলছেন, গণহত্যা ও নির্যাতন বন্ধে মায়ানমারকে চাপ দিচ্ছেন। বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করছেন। এ সবই হলো আমাদের রাজনীতিবিদদের অর্জন। ফলে এ কথা দৃঢ়ভাবেই বলতে পারি- রাজনীতিতে এমন মানবিকতার দৃষ্টান্ত বিরল, যা দেখাতে পেরেছে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে শুধু মানবিকতার দিকটিই ফুটে উঠেনি বাংলাদেশ ও এর রাজনীতিদের ভাবমূর্তিও বিশ্ব দরবারে উজ্জ্বল হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।
এইতো একটু দেরিতে হলেও মঙ্গলবার কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী এবং তার বোন রেহেনাকে কাছে পেয়ে সবহারানো রোহিঙ্গারাও আবেগ আপ্লুত হয়েছেন।এ সময় অনেক অসহায় রোহিঙ্গাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। চোখের অশ্রু জড়িয়েছেন তারা। দেশে থাকলে খালেদা জিয়াও হয়তো এমনটিই করতেন। এরপরও আমার দৃঢ় বিশ্বাস- খালেদা দেশে ফিরেই নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের কাছে যাবেন।
এদিকে গণমাধ্যমের খবরে জানা গেল মঙ্গলবার দুপুরেই বিএনপির ত্রাণ পৌঁছেছে উখিয়ায়। বুধবার সকালেই জাতীয় নেতারা তা রোহিঙ্গাদের মাঝে বিতরণ করবেন। সবমিলেই আমরা বলতে পারি- অনেক সমস্যার মধ্যেও আমাদের রাজনীতি অন্যান্য যে কোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি মানবিক।
ভাবতে পারেন,আমাদের রাজনীতিবিদরা এই ইস্যুতে মানবিক না হলে আরাকানে আরো কত রোহিঙ্গাকে প্রাণ দিতে হতো, গণহত্যার শিকার হতে হতো আরো কত নারী-পুরুষ ও শিশুকে। বাংলাদেশের এই দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে, মানবিকতার ইতিহাসে এক নতুন দৃষ্টান্ত। ফলে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলতে চাই- রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরো বেশি মানবিক হোন। নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমরা আমাদের জন্য অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ। ভূমি-রিজিক মানুষের সৃষ্টি নয়,মহান আল্লাহর দান।ফলে হিজরতকারী নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার বদৌলতে যেমন আমাদের রিজিক বেড়ে যেতে পারে তেমনি বাংলাদেশ বিশ্বের জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত তথা ‘রোল মডেল’ হয়ে থাকবে।
সবশেষে বলবো- শুধু আশ্রয় কিংবা ত্রাণ নয়, জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের ‘নিজ দেশে পরবাসী’ করা হয়েছে সেব্যাপারেও সোচ্চার হতে হবে। রোহিঙ্গাদের হাজার বছরের জনপদ ‘স্বাধীন আরাকান’ ফিরিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাই রোহিঙ্গদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন দিন, বিশ্ব দরবারে তাদের স্বাধীনতার দাবিকে তুলে ধরুন। তবেই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান:
আরটিএনএন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন