রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের উন্নয়নসহযোগী দেশ চীন, ভারত ও রাশিয়ার অবস্থানে চিন্তিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দেশের চরম এ সঙ্কটকালীন মুহূর্তে বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর জোরালো সমর্থন না পাওয়া উল্টো কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে সরাসরি সমর্থনে বেশ ক্ষুব্ধ সরকার। অবস্থার পরিবর্তনে নানা কৌশলে এগোচ্ছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। তবে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো উল্লিখিত প্রভাবশালী দেশগুলোও একসময় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে বলে আশাবাদী তারা।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ওপর রোহিঙ্গাদের এ চাপকে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে সরকার। সরকারের প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকেরাও বিষয়টি অকপটে বলে আসছেন। এ ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর শুধুমাত্র অতিরিক্ত শরণার্থীর চাপই নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু ও সহযোগী এবং উন্নয়নের বিপক্ষে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি সীমারেখা তৈরি করতে পারে এ রোহিঙ্গা ইস্যু, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ণয়ে সহযোগিতা করতে পারে। সে জন্য রোহিঙ্গা ইস্যুকে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তা মোকাবেলার জন্য সর্বাত্মকভাবে কাজ করছে সরকার।
সূত্রগুলো জানায়, রোহিঙ্গা সমস্যায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম বন্ধু দেশ ভারত শুরু থেকেই মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নেয়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ইতিহাসের জঘন্য ও বর্বর গণহত্যা এবং বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ঢলের মধ্যেই মিয়ানমার সফর করে জোরালো সমর্থনের কথা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর কয়েক দিন পরই ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভেটো প্রদান করে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে ভারতে থাকা ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পঠানোর ঘোষণাও দেয় ভারত। বিষয়টি নিয়ে খানিকটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে বাংলাদেশ সরকার। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা এবং বাংলাদেশের জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতায় খানিকটা অবস্থান বদল করে ভারত। এর অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে উদ্বেগ জানান ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। এর একদিন পরই রোহিঙ্গাদের জন্য ৫৩ টন ত্রাণ পাঠায় ভারত সরকার। তবে ভারত মিয়ানমারে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির কথা ভাবছে বলে গত বৃহস্পতিবার রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়। মিয়ানমার নৌপ্রধানের ভারত সফরে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিয়য়টি মিয়ানমারের প্রতি ভারতের জোরালো সমর্থনের ইঙ্গিত বহন করে।
অন্য দিকে বাংলাদেশের আরেক প্রভাবশালী উন্নয়ন সহযোগী দেশ চীন শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যু আলোচনায় ভেটো দেয় দেশটি। সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং জাতিসঙ্ঘের বারবার মানবিক আহবানের পরও দেশটি কোনোভাবেই নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করছে না।
আর বাংলাদেশের আরেক বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়াও একইভাবে মিয়ানমারের অবস্থানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশগুলোকে নাক না গলানোর আহবান জানাচ্ছে দেশটি। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে উল্লিখিত তিনটি দেশকে পক্ষে আনতে বেশ হিমশিম খাচ্ছেন বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও নীতিনির্ধারকেরা।
ওই দিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রথম দিকে খানিকটা নীরবতা অবলম্বন করলেও পর্যায়ক্রমে সরব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ইস্যুতে মিয়ানমারের সমালোচনা করে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসাও করেছেন দেশটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তারা। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রোহিঙ্গাদের সাহায্যে ২৩ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। তবে সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনের এক ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কুশল বিনিময়ের সময় শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ টানলে ট্রাম্প কোনো মন্তব্য করেননি। বিষয়টি নিয়ে খানিকটা মর্মাহত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা ঘটনাটি উল্লেখ করে বলেন, রোহিঙ্গা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কিছু আশা করি না। কারণ, ট্রাম্পের কাছে বিষয়টি তুলেছিলাম। কিন্তু তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
সরকারের সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর সাথে রোহিঙ্গাদের অতিরিক্ত এ চাপ মোকাবেলায় প্রতিবেশী ভারত, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করছে বাংলাদেশ। কিন্তু উল্লিখিত প্রভাবশালী দেশগুলোর ভূমিকা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে সরাসরি সমর্থন বাংলাদেশকে হতাশ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিকাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
গত ২১ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে জয় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা ঠেকাতে মিয়ানমারের ওপর জরুরিভাবে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করে বলেন, বিশেষ করে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।
তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে বাংলাদেশের জিরো টলারেন্স অবস্থানের প্রশংসাকারী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানেন, এ অস্থিতিশীল অবস্থা ও বাস্তুচ্যুত মানুষের কারণে সন্ত্রাসের প্রজননক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে সম্প্রতি মোদি এ ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারকে চাপ দিয়েছেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রের পালা, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটা বিবৃতি বা টুইট ব্যাপক কর্তৃত্ব তৈরি করবে। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশের প্রয়োজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা বলেন, ‘মিয়ানমার যেখানে রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের ইস্যু বলে মন্তব্য করছে সেখানে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারত, চীন ও রাশিয়ার অবস্থান আমাদের হতাশ করেছে। কারণ, আওয়ামী লীগকে ভারতের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে বলা হয়। আর এ সরকারের সাথে চীনেরও একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের বড় বড় উন্নয়নে অংশীদার হিসেবে আছে চীন। বর্তমান সরকারের সময়ই চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়ে গেছেন। অন্য দিকে রাশিয়ার সাথে জন্মলগ্ন থেকেই সামরিক সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু ভারতের কৌশলী অবস্থান এবং চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারকে সরাসরি সমর্থন আমাদের জন্য চরম বিব্রতকর। তবে সরকার বসে নেই। কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত আছে। আমরা আশা করি তাদের সমর্থন আদায়ে সফল হবো।’
এক নেতা বলেন, ‘আসলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের প্রকৃত বন্ধু ও শত্রু কারা তা ফুটে উঠছে। এটি ভবিষ্যতে আমাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ণয়ে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে।’
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, এ সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভারত, চীন ও রাশিয়ার সমর্থন আমাদের জন্য খুব বেশি প্রয়োজন। সে জন্য কূটনৈতিক তৎপরতাও সেভাবে চলছে। জাতিসঙ্ঘে ট্রাম্পের সাথে শেখ হাসিনার কুশলবিনিময় এবং পরবর্তী মন্তব্যও সেই কৌশলের অংশ। আসলে ট্রাম্পের প্রতি একরকম অনাস্থা দেখিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিপরীতমুখী চীন ও রাশিয়াকে কাছে পেতে চেয়েছেন বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমরা কোনো ধরনের উসকানিতে পা দেবো না। যুদ্ধ নয়, আলাপ আলোচনা ও শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমধান চাই। জাতিসঙ্ঘের চলতি অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্য বিশ্ব নেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ও নজর কেড়েছে। অনেক দেশ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। আশা করি অন্য দেশগুলোও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকেই সমর্থন করবে।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক নানা হিসাব-নিকাশের কারণে আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত প্রথম দিকে দোটানায় থাকলেও এখন সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ পুরো মুসলিমবিশ্ব আজ শেখ হাসিনার পাশে। তিনি আজ সারা বিশ্বে মানবিক নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। সরকারের কূটনৈতিক কৌশল ও তৎপরতায় অন্য দেশগুলোও পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশকেই সমর্থন করবে বলে আমরা আশাবাদী।
নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন