একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপে অংশ নেয়া ১৮টি রাজনৈতিক দলের অধিকাংশই নির্বাচনকালীন সরকার ও সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে।
সংলাপে অংশ নেয়া ১৫টি দল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক/সহায়ক/জাতীয় পরিষদ/তদারকি সরকারের পক্ষে মত দিয়েছে।
আর নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছে ১৩টি দল। না ভোট রাখার কথাও বলেছে কয়েকটি দল।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে গত ২৪ আগস্ট থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মতবিনিময় সভায় দলগুলো এসব প্রস্তাব দিয়েছে।
দলগুলোর প্রধান প্রধান দাবিগুলো নিচে তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল)
সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার আগে বর্তমান সংসদ ও মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেয়া; নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়ক সরকার; নির্বাচনের তারিখের ৩০ দিন পূর্বে ও নির্বাচনের পরের ১৫ দিন পর্যন্ত বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েন করা; কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রকাশ্যে ভোট গণনা শেষে প্রত্যেক প্রার্থীর এজেন্টের স্বাক্ষর নিয়ে ভোটের ফলাফল প্রকাশ করা।
খেলাফত মজলিশ
সহায়ক সরকার; বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন; দলের নিবন্ধন শর্ত শিথিল করা।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়া; তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনকালীন তদারকি সরকার গঠনে রাজনৈতিক সমঝোতা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে রাখা; ভোটার সংখ্যা অনুপাতে সংসদীয় আসন পুনর্নির্ধারণ করা; ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা; প্রবাসীদের ভোটাধিকার; অনলাইন মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট
রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধি রাখার বিধান বাতিল; সেনাবাহিনী মোতায়েন; ইসির অধীনে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে রাখা।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
সেনা মোতায়েন; সংসদ ভেঙে অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করা; অনলাইনে মনোনয়ন দাখিল।
খেলাফত মজলিশ
নির্বাচন নিরপেক্ষ অস্থায়ী সরকারের অধীনে করা; নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়া ও সেনা মোতায়েন; নির্বাচনের সাত দিন আগে থেকে নির্বাচনের ৭২ ঘণ্টা পর পর্যন্ত সেনাবাহিনী মোতায়েন করা; অনলাইনে মনোনয়নের ব্যবস্থা করা; প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও প্রবাসীদের ভোটার করা।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ভোট গ্রহণের কমপক্ষে ৮ দিন আগে সেনা মোতায়েন; সহায়ক সরকার; সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসির সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা করা।
ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন
নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততার প্রয়োজন নেই; কালো টাকা, সন্ত্রাস ও পবিত্র ধর্মের অপব্যবহার মুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা; মনোনয়নপত্র অনলাইনে জমা দেয়া।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি
তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি নিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠন করা; একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বেই ১০ম জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া; নির্বাচনের তিন মাস পূর্ব থেকে নির্বাচনের পরবর্তী কমপক্ষে এক মাস পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ব্যবস্থা করা; যে সব কর্মকতার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল বা আছে এমন কর্মকর্তাদের নির্বাচন পরিচলনার সব পর্যায়ে দায়িত্ব প্রদান থেকে বিরত রাখা; প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে যেকোনো ধরনের অনিয়ম রোধে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা; প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে বিদেশে অবস্থিত দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোতে তাদের ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এ ভোটগ্রহণ কার্যক্রমে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল না বা বর্তমানে নেই এমন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব প্রদান নিশ্চিত করা; ব্যালট পেপারে ‘না’ ভোটের বিধান চালু করা।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ)
নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা; তফসিল ঘোষণার আগেই সংসদ বিলুপ্ত ও বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা।
প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি (পিডিপি)
প্রধানমন্ত্রীকে ঐচ্ছিক ছুটি গ্রহণ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নির্বাহী প্রধান করে অপরাপর কমিশনার এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও সরকারি কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হতে পারে। তবে শর্ত থাকে যে, একই সময় মন্ত্রী পরিষদ ও পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া; সেনাবাহিনীকে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থেকে সাধারণ ভোটারদের ভোটদানের নিশ্চয়তার বিধান করা; পোলিং ও প্রিজাইডিং অফিসারদের নিরাপত্তা বিধানে সেনা বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে কেন্দ্রে অবস্থানের সুযোগ দেয়া; জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের পরিবর্তন আনা যায় কিনা বিষয়টি বিবেচনা করা।
গণফ্রন্ট
বর্তমান সরকারকে সংবিধান সংশোধন করে হলেও (তত্ত্বাবধায়ক নয়, অরাজনৈতিক সরকার নয়) একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। স্বাধীনতার পরে যে সব নিবন্ধিত দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল (‘বিতর্কিত’ নির্বাচন যেমন ৮৮, ৯৬ এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ব্যতিত) তাদের সমন্বয়ে একটি সরকার গঠন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সমঝোতার মাধ্যমে সে সরকারের প্রধান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। তবে নির্বাচনকালীন সরকারের কেউ জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর পাশাপাশি প্রয়োজনে সেনা সদস্য মোতায়েন করা; সংসদের আসন ন্যূনতম সংখ্যা ৩৫০/৪৫০টি করা; প্রবাসীদের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাদের সহজে ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা করা; দেশ, জনগণ, গণতন্ত্রের স্বার্থে বিতর্কিত নির্বাচন নয়, সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা।
গণফোরাম
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন যে সরকার থাকবে ও যে প্রশাসন থাকবে তাদের নিরপেক্ষ থাকা; ‘মানি পাওয়ার (অর্থের দাপট)’ ও ‘মাসল পাওয়ার (পেশী শক্তি)’ নিয়ন্ত্রণ করা; প্রশাসনকে হস্তক্ষেপমুক্ত রাখা; প্রবাসীদের ভোটাধিকার; নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি; ঋণ খেলাপিদের জামিনদারকে নির্বাচনে অযোগ্য; নির্বাচনে ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করা ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল; সেনাবাহিনী মোতায়েন করা; নির্বাচনের এক বছর আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অবাধ সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পরিবেশ তৈরিতে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগ গ্রহণ করা; অবৈধ ও কালো টাকার মালিকরা নির্বাচনে যেন অংশগ্রহণ করতে না পারে সে ব্যবস্থা করা; প্রবাসীদের ভোটারধিকার নিশ্চিত করা।
ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)
বিগত জাতীয় নির্বাচনে নিবন্ধিত যেসব দল অংশ নিয়েছিল, তাদের থেকে প্রতিনিধি নিয়ে সরকার করা; ভোটে ঢালাওভাবে সেনা মোতায়েনের দরকার নেই, সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চয়তা, অনলাইনে মনোনয়পত্র জমা, প্রবাসী ভোটাধিকারের ব্যবস্থা করা।
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি ( জাগপা)
নির্বাচনের সময় পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া; নির্বাচনকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা বাতিল করে তিন মাসের অবকাশকালীন ছুটি দেয়া; বাংলাদেশের নাগরিক অবসারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সাবেক বিচারপতি এবং দেশের বিশিষ্টজনদের সমন্বয়ে সৎ গ্রহণযোগ্য নির্দলীয় ব্যক্তি দ্বারা সরকার গঠন করা; ৩০ দিন আগে বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করা।
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট
নির্বাচনী বিধি-বিধান সংস্কারে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানদের নিয়ে ‘জাতীয় পরিষদ’ গঠন করা; প্রবাসীদের ভোটদানের সুযোগ দেয়া।
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ
তফসিল ঘোষণার পর সংসদ ভেঙে দিয়ে তিন ধাপে নির্বাচন করা; না ভোটের বিধান রাখা; প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা করা; অনলাইনে নমিনেশন ফরম জমাদানের ব্যবস্থা রাখা।
রাজনৈতিক দলের মতামতের বিষয়ে ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘কমিশন সব দলের মতামত নেবে। তারপর সেখান থেকে যেগুলো গ্রহণ করার মতো সেগুলো গ্রহণ করবে।’
গত ৩১ জুলাই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শুরু হওয়া ধারাবাহিক এ সংলাপ চলবে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত।
২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন