রোহিঙ্গা বিতাড়নে এবার খাদ্য ধ্বংস, পানির উৎসে দূষণ
রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণরুপে নির্মূলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও উগ্রপন্থি বৌদ্ধরা হত্যা-নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে তারা রোহিঙ্গাদের গ্রাম ও বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে। এবার এর সঙ্গে যোগ করেছে খাদ্য ধ্বংস ও খাবার পানির উত্স নষ্ট করে দেওয়া। রাখাইনে কৃষকদের মজুদ রাখা চালের দোকান ও গুদাম পোড়ানো হচ্ছে। খাবার পানির সংকট সৃষ্টিতে গ্রামের নলকূপ ও পুকুরের পানি পর্যন্ত নষ্ট করে দিচ্ছে। যাতে বন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা খাদ্য ও খাবার পানির অভাবে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে জরুরি ত্রাণ তত্পরতা চালাতে রাখাইনে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।
সবধরনের কঠোর তত্পরতা গ্রহণ করায় দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। গত সোমবার একদিনে ১১ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা। তবে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা দাবি করেছে এ সংখ্যা দ্বিগুণ। রোহিঙ্গা প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় সংস্থাটি সম্পূর্ণ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছে। খাদ্য ও পানি ছাড়া এই মানুষগুলো দীর্ঘদিন পায়ে হেঁটে মুমূর্ষু অবস্থায় বাংলাদেশে এসে পৌঁছছে।
জাতিসংঘের শারণার্থী বিষয়ক সংস্থার মুখপাত্র এড্রিয়ান এডওয়ার্ডস বলেছেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বাড়ায় আমরা ফের পূর্ণ সতর্ক অবস্থায় ফিরেছি।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, নতুন যারা এসেছে তারা হত্যাকা্ল ও গ্রামে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এদের অনেকেই পানিবাহিত নানা ধরনের রোগে ভুগছে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে জখমও হয়েছে। এদিকে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কলেরার টিকা খাওয়ানোর কর্মসূচি নিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ। তাদের বিশ্বাস এর ফলে জনাকীর্ণ ক্যাম্পে বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে সৃষ্ট ডায়রিয়াজনিত অসুখ প্রতিরোধ হবে। গত কয়েক সপ্তাহে ১০ হাজারের বেশি ডায়রিয়া রোগী শনাক্ত করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা।
অন্যদিকে, পোপ ফ্রান্সিস আগামী মাসে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফর করবেন। মিয়ানমারে তিনি দেশটির জ্যেষ্ঠ বৌদ্ধ ভিক্ষু ও কার্যত সরকারপ্রধান অং সান সুচির সঙ্গে সাক্ষাত্ করবেন বলে জানা গেছে। এছাড়া সেখানে তিনি রাজনৈতিক নেতা ও কূটনীতিকদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রয়েছে মিয়ানমার। এরআগে গত ফেব্রুয়ারিতে পোপ ফ্রান্স বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা তাদের সংস্কৃতি ও ইসলামধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে চায় বিধায় নির্যাতন ও হত্যাকা্লের শিকার হচ্ছে। মিয়ানমার সফরশেষে পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশ সফর করবেন।
উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, গতকাল মঙ্গলবার ভোরে রাখাইনের খেয়াংমং থেকে পালিয়ে এসেছেন ফাতেমা বেগম (২৮)। কুতুপালং মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। তিনি জানান, তাদের দীর্ঘদিনের সঞ্চিত সহায় সম্বল বুকে আকঁড়ে ধরে, জীবন বাজি রেখে মাতৃভূমিতে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থি বৌদ্ধরা তাদের খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ কারণে সেখানে আর থাকা হয়নি। আগত রোহিঙ্গারা দাবি করেন তারা প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা থাইংখালী সীমান্ত দিয়ে নাফনদী পার হয়ে ভোরে কুতুপালং এসে পৌঁছেছেন। তারা বলেন, দিনের বেলায় জঙ্গলে ও রাতের আধাঁরে ঘরবাড়িতে থাকার চেষ্টা করেছিল। সেনারা তা জানতে পেরে তাদের সহায়সম্বল জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে।
রাখাইনের শিলখালী গ্রামের আবুল কালাম (৩৫) জানান, তার বসতবাড়িতে ধান চালসহ নিত্য পণ্যের মজুদ ছিল। ছিল গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, শতাধিক হাঁস-মুরগি। এসবের মায়ায় পড়ে গেছেন তিনি। স্ত্রী ও সন্তানদের বাংলাদেশে পৌঁছে দিয়ে তিনি বাড়িতে থেকে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেনারা সোমবার সকালে এসে তার দোতলা কাঠের ঘরটি জ্বালিয়ে দেয়। নিঃস্ব হয়ে তাকে এপারে চলে আসতে হয়েছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মুফিজ মেম্বার জানান, সোমবার রাত দেড়টার দিকে শোরগোল শুনে বাড়ি থেকে বের হন। দেখেন শত শত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু নাফনদী পার হয়ে বাড়ির পাশ দিয়ে থাইংখালীর দিকে যাচ্ছে।
পালংখালী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য সোলতান আহমদ জানান, সোমবার রাতের মতো এমন করুণদৃশ্য আর দেখিনি। কয়েকটি পরিবার তাকে জানিয়েছে, টানা সাতদিন দুর্গম পাহাড়ি পথে তারা হেঁটেছেন। কোন খাবার পাননি। হাঁটার পথে মায়ের কোলে একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। রোহিঙ্গারা পালংখালী ইউনিয়নের বাঘঘোনা নামক স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।
সেখানে আশ্রিত আজিম উল্লাহ বুচিডং শীতলক্ষ্য এলাকার কোয়ামং এলাকার বাসিন্দা। স্ত্রী ও ৯ সন্তান নিয়ে ৬ দিনে আগে বাড়ি থেকে রওনা হন। আজিম উল্লাহ বলেন, তাদের মংডু এলাকায় মিয়ানমার জান্তারা খাবার না দিয়ে দু’দিন আটকে রাখে। সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে চারদিন পর গতকাল সকালে বাংলাদেশে এসে পৗঁছেছেন।
আরো ১২ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার
টেকনাফে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির ঘটনায় আরো ১২ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। উপজেলার সদর ইউনিয়নের মহেশখালীয়া পাড়া ও মিঠাপানীর ছড়া সংলগ্ন সমুদ্র সৈকতে লাশগুলো ভেসে আসে। খবর পেয়ে পুলিশ, কোস্টগার্ড ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন লাশগুলো উদ্ধার করে। এদের মধ্যে দুইজন নারী, একটি শিশুর লাশ ছিল। লাশগুলো স্থানীয়রা দাফন করেন। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির ঘটনায় ২৫ জনের লাশ উদ্ধার হলো।
ইয়াংগুনে আন্তধর্মীয় প্রার্থনা
রাখাইনে সহিংসতার পর বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের অভিপ্রায়ে মিয়ানমার গতকাল বুধবার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে শত্রুতার অবসানে অং সান সুচি এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। গতকাল দেশটির বৃহত্তম শহর ইয়াংগুনের একটি স্টেডিয়ামে বৌদ্ধ, মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টানসহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের একটি আন্তধর্মীয় প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন ধর্মের কয়েক হাজার অনুসারী এতে অংশ নেয়। ধর্মীয় নেতারা এসময় বয়ান রাখেন।
ইয়াংগুনের প্রধান বৌদ্ধ ভিক্ষু ইধিবালা আগতদের উদ্দেশ্যে বলেন, একে অন্যকে হত্যা থেকে বিরত থাক, একে অন্যকে নির্যাতন করা থেকে বিরত থাক, একে অন্যকে ধ্বংস কিংবা বিনাশ থেকে বিরত থাক। মঞ্চ থেকে নামার সময় তিনি মুসলমান ধর্মীয় নেতা হাফিজ মুফতি আলীর সঙ্গে হাত মেলান। হাফিজ মফতি আলী বলেন, নাগরিকরা দেশের জন্য কাজ ও বন্ধুতার জন্য সহযোগিতা করবে। জীবনের স্বাধীনতা, শিক্ষার স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা - এসকল অধিকার অবশ্যই রাষ্ট্রকে পূরণ করা প্রয়োজন।
আরসার যুদ্ধবিরতি শেষ
আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) একমাসের যুদ্ধবিরতির সময়সীমা গত সোমবার শেষ হয়েছে। আরসা আলাপ আলোচনার প্রস্তাব দিলেও মিয়ানমার সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটির সরকারের বক্তব্য, কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলতে পারে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন