মাঠে-ঘাটে, পাড়া-মহল্লায় ও চায়ের দোকানে নির্বাচনী আড্ডা জমে উঠেছে। এখনই দিনরাত উঠান বৈঠক, পথসভা ও গণসংযোগে তৎপর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
বলা হচ্ছে বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনের কথা, যেখানে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোস্টার-ফেস্টুন লাগানোর প্রতিযোগিতা চলছে।
বগুড়ার গুরুত্বপূর্ণ এ আসন জাতীয় সংসদের ৩৭ নম্বর নির্বাচনী এলাকায়। শুধু শিবগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনটি বর্তমানে জাতীয় পার্টির দখলে। বিগত নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট অংশ না নেওয়ায় মহাজোট থেকে মনোনয়ন পান বগুড়া জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শরীফুল ইসলাম জিন্নাহ। তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এখন এই নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এবং দলীয় নেতাকর্মীদের সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষণীয়। অন্যদিকে সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল হলেও বিএনপির জনসমর্থন বেশি। আর জামায়াতের প্রকাশ্য কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও গেল উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপির প্রার্থীকে বড় ব্যবধানে পরাজিত করে দলটির নেতা আলমগীর হোসাইন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। জামায়াতের নেতাকর্মীরা প্রথম দিকে বগুড়ার রাজনৈতিক মাঠ দখল করে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি।
কয়েক হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা থাকায় এবং তাদের বেশির ভাগ জেলে থাকায় বর্তমানে দলটি কোণঠাসা। এত কিছুর পরও গেল ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জামায়াতের একাধিক প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। প্রকাশ্যে কার্যক্রম না চালালেও দলটির নেতারা গোপনে সাংগঠনিক ভিত মজবুত করছেন। এ কারণে বগুড়া-২ আসনটি নিয়ে সব দলের প্রার্থীরাই চিন্তিত। সহজভাবে কোনো প্রার্থীই ওই আসনটিতে লড়তে পারবেন না—এমনটিই মনে করে সাধারণ ভোটাররা।
এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেকের নামই আলোচনায় উঠে আসছে। এ তালিকায় এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আটজন এবং বিএনপির ছয়জনের নাম রয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
এ ছাড়া জাতীয় পার্টির বর্তমান সংসদ সদস্য আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী হবেন। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) মাহমুদুর রহমান মান্নার নামও আলোচনায় রয়েছে।
প্রসঙ্গত, শিবগঞ্জ আসনটি বগুড়া জেলার উত্তর সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত। এ উপজেলায় রয়েছে আড়াই হাজার বছরের পুরনো পুণ্ড্রনগরী মহাস্থানগড়। মহাস্থানগড়ের কারণে অন্যান্য উপজেলার চেয়ে শিবগঞ্জের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এ কারণেই আগে আগেই আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে তৎপর রয়েছেন। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে তৎপর হয়ে উঠেছেন তাঁরা। গেল ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সময় তাঁরা গণসংযোগ করেন এবং পোস্টার-ফেস্টুনের মাধ্যমে ঈদের শুভেচ্ছা জানান।
জাতীয় পার্টি : আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য শরীফুল ইসলাম জিন্নাহ আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন বলে নিশ্চিত করেছেন। তবে মাঠপর্যায়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জিন্নাহ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকায় উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ হয়নি। তিনি ও তাঁর পরিবারের একাধিক সদস্য বিগত সময়ে শুধু ‘কমিশন বাণিজ্য’ চালিয়ে গেছেন। তাঁর ছেলের বেপরোয়া চালচলন এলাকায় বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এতে করে সাধারণ মানুষ মনে করছে, এবার অন্য প্রার্থী খোঁজার সময় হয়েছে।
আওয়ামী লীগ : এ আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত আটজনের নাম শোনা যাচ্ছে। তাঁদের বেশির ভাগই বলেছেন, কেন্দ্রীয় সমর্থন পেলে নির্বাচন করবেন, না পেলে করবেন না। সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আজিজুল হক, সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজার রহমান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম ফকির, পৌর মেয়র তৌহিদুর রহমান মানিক, সাবেক মন্ত্রী মোজাফ্ফর হোসেন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. রেজাউল আলম জুয়েল, ব্যবসায়ী আকরাম হেসেন, জেলা পরিষদ সদস্য ও জেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি আব্দুল করিম।
এসব প্রার্থীর মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আজিজুল হকের নামে একাধিক মামলা রয়েছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিল বকেয়ার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। অন্যদিকে দলের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজার রহমান তাঁর পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পেরেছেন।
মোস্তাফিজার বলেন, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত তাঁর পক্ষে গেলে তিনি নির্বাচন করবেন। মনোনয়ন পেলে জয়ী হবেন—এমন আশাও তিনি ব্যক্ত করেছেন। তিনি বর্তমানে উঠান বৈঠকের পাশাপাশি দলীয় কার্যক্রম জোরালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। মাঠের নেতাকর্মীরাও তাঁকে চাচ্ছে। তিনি নির্বাচন করলে নৌকার ভোট প্রায় দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে নেতাকর্মীরা জানিয়েছে।
সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কাশেম ফকির দলের জ্যেষ্ঠ নেতা। দুঃসময়ে দলে থেকে নেতাকর্মীদের আগলে রেখেছেন। এ কারণে তাঁরও একটা বড় ধরনের জনসমর্থন রয়েছে।
এদিকে পৌর মেয়র তৌহিদুর রহমান মানিকও ভোটের মাঠে রয়েছেন। তিনি তৃণমূলের কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে এগোচ্ছেন। স্বাধীনতার পর বগুড়ায় তিনিই প্রথম নৌকা প্রতীক নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
মানিক বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য আমি মাঠে অনেক আগে থেকেই কাজ করে যাচ্ছি। রাতদিন বিবেচনা না করে যেকোনো মানুষের সমস্যায় তাদের পাশে দাঁড়াই। সাধারণ মানুষ আমাকে যেকোনো সময় ডাকলে কাছে পায়। আমাকে তারা ভালোবাসে। ’ দলীয় সমর্থন পেলে তিনি জয়ী হবেন বলে দাবি করেন মানিক।
বিএমএ বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ ডা. রেজাউল আলম জুয়েল বিশিষ্ট অর্থোপেডিক সার্জন। তিনি বগুড়া বিএমএর পর পর তিনবার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া তিনি বগুড়া জেলা শাখা স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাধারণ সম্পাদক।
এলাকার লোকজন জানায়, গত ২০ বছর ধরে ডা. জুয়েল তাঁর নিজ এলাকায় প্রতি শুক্রবার বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন।
ডা. জুয়েল জানালেন, দলীয় মনোনয়নের জন্য তিনি কেন্দ্রের দৃষ্টিতে আছেন। মাঠে সাংগঠনিক কার্যক্রমের পাশাপাশি নির্বাচনী প্রস্তুতিও তিনি নিচ্ছেন। দল চাইলে লড়বেন।
বিএনপি : সংসদের বাইরে থাকা দলটির সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হলেও ভোটের মাঠে ছয় সম্ভাব্য প্রার্থীর আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব থাকলেও এখন সেই দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করছেন এসব নেতা। নিয়মিত কর্মীদের খোঁজখবর রাখার পাশাপাশি দলীয় ছোটখাটো কর্মসূচিতে উপস্থিত হচ্ছেন তাঁরা। গেল রোজায় ইফতার মাহফিলকে প্রচারের মাধ্যম হিসেবে তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন। ঈদুল আজহায়ও তাঁরা জনগণের পাশে ছিলেন।
এ আসনের বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় আছেন সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম হাফিজুর রহমান, বগুড়া জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মীর শাহে আলম, শিক্ষাবিদ মোস্তাফিজুর রহমান, শিবগঞ্জের সাবেক পৌর মেয়র মতিউর রহমান, উপজেলা বিএনপির সভাপতি কামাল সেলিম ও এম আর ইসলাম স্বাধীন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির এই নেতাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সুনজরে রয়েছেন জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মীর শাহে আলম। তিনি দলের তরুণ নেতা। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে দক্ষতা থাকায় তিনি শুরু থেকেই দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানের সান্নিধ্যে ছিলেন। এ কারণে দলের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়ে বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি অংশ নেন। দল থেকে বহিষ্কার হয়েও তিনি বিজয়ী হন। এরপর তারেক রহমানের নির্দেশে তাঁকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এসব কারণেই এবারও বিএনপি থেকে তিনিই একমাত্র শক্তিশালী প্রার্থী। এলাকার তরুণ ভোটাররা এখন একটা বড় ফ্যাক্টর। এই ভোটাররা তরুণ নেতা হিসেবে মীর শাহে আলমকে চায়—এমন মন্তব্যই পাওয়া গেছে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ভোটারের সঙ্গে কথা বলে।
এ ছাড়া মাঠে থাকা সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম হাফিজুর রহমান বলেন, ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনের টিকিট তিনিই পাবেন। সে অনুযায়ী মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর মতে, সুষ্ঠু ভোট হলে জনগণ তাঁকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে।
আর রাজনীতিতে দলীয় নিবন্ধন বাতিল হলেও এই আসনে আলোচনায় আছে জামায়াতে ইসলামী। শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবু নসর মো. আলমগীর হোসাইন যেকোনো প্রতীক নিয়ে লড়তে পারেন এই আসনে। সব রকমের প্রস্তুতিই তাঁর রয়েছে।
বগুড়ার রাজনীতিতে জামায়াতের কার্যক্রম না থাকলেও দলটির নেতাদের দাবি, তাঁরা যথেষ্ট সংগঠিত। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে যেকোনো প্রতীক নিয়ে ভোটে লড়ে জয়ী হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন জামায়াতের একাধিক নেতা।
এদিকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্নাও এই আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। মান্না বলেন, তিনি কোন আসন থেকে নির্বাচন করবেন সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি। তবে তিনি শিবগঞ্জের সন্তান। সেখানকার মানুষ তাঁকে নির্বাচনে চায়। তিনি আরো জানান, আসছে নির্বাচন নিরপেক্ষ হলে তিনি যে আসন থেকেই নির্বাচন করেন, জনগণ তাঁকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করবে। কালের কণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন