প্রকাশ্যে এক সহকর্মীকে গুলি করেও পার পেয়ে গেলেন উত্তর চট্টগ্রামের আলোচিত আওয়ামী লীগ ও পরিবহন শ্রমিক লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু। ঘটনার পর পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত রাখতে পারেনি। আটকের ২০ ঘণ্টা পর তাকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। মঞ্জুরুল আলম ঘটনাকে অনাকাক্সিক্ষত, অনিচ্ছাকৃত ও দুঃখজনক বলে অভিহিত করে ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলে জানিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে
অভিযোগকারী অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কোতোয়ালি থানার ওসি জসিম উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘আপস-মীমাংসার কারণে মঞ্জুরুল আলমকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ঘটনার জন্য তিনি (মঞ্জুরুল আলম) দুঃখ প্রকাশ করে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না বলে মুচলেকা দিয়েছেন।’ জানা গেছে, আটকের পর মঞ্জুরুল আলমকে এক মিনিটের জন্যও লকআপে ঢোকানো হয়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, তিনি কি এতই প্রভাবশালী?
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চতুর্মুখী চাপ ও অনুরোধে এই পরিবহন শ্রমিক নেতার বিরুদ্ধে দাখিল করা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন অভিযোগকারী যুবলীগ নেতা জয়নাল আবেদীন। চট্টগ্রামের সাবেক ও বর্তমান মেয়র, মন্ত্রী-এমপি ছাড়াও নগর ও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের প্রায় সবাই আপসের মাধ্যমে এ ঘটনার সুরাহা চেয়েছিলেন। ভূমি প্রতিমন্ত্রীর কাছেও এ ঘটনার আপস-মীমাংসার জন্য বিভিন্ন পর্যায় থেকে অনুরোধ ছিল। এমন অনুরোধ তারা যেমন ফেলতে পারেননি, তেমনি প্রশাসনও এর বাইরে যেতে পারেনি।
শনিবার রাত ১১টার দিকে একজন অতিথিকে জেলা প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত অফিসার্স ক্লাবে আনার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে গাড়ি থেকে পিস্তল বের করে এনে জয়নাল আবেদীনের পায়ে গুলি করেন উত্তর জেলা আওয়ামী লাগের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও পরিবহন শ্রমিক নেতা মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু। এতে জয়নাল আবেদীনের বাঁ পায়ের একটি আঙুল ও হাড় ভেঙে গেছে। ঘটনার পরপরই কোতোয়ালি থানা পুলিশ তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
সূত্র জানায়, আটক হওয়ার পর থেকে তাকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য নানাভাবে তৎপরতা শুরু হয়। নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ ছালাম, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরীসহ একাধিক মন্ত্রী-এমপি মঞ্জুরুল আলমের বিরুদ্ধে দাখিল করা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে বিভিন্নভাবে অনুরোধ করেন। আহত জয়নাল আবেদীনের ভাই আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ সদস্য এসএম আলমগীর চৌধুরীকে ফোনের পর ফোন করেন অনেকেই। তাদের অনেকে আবার ভূমি প্রতিমন্ত্রী ও আনোয়ারার সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদকেও ফোন করেন বিষয়টি আপসে মীমাংসার জন্য। যেহেতু আহত জয়নাল আবেদীনের বাড়িও আনোয়ারায় তাই তিনি বললে ঘটনা অপসে নিষ্পত্তি করা যাবে- এমন ধারণা থেকেই সবাই তাকে ফোন করেন। রোববার রাত ৯টায় কোতোয়ালি থানায় উভয়পক্ষের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে উভয়পক্ষের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা প্রার্থনা ও ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না বলে মুচলেকা দিতে রাজি হন মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু।
বৈঠকে উপস্থিত জয়নাল আবেদীনের ভাই ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ সদস্য এসএম আলমগীর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘মঞ্জুরুল আলম আটক হওয়ার পর যেভাবে মেয়র, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, দলের জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা নানা মাধ্যমে ফোন করে অনুরোধ করেছেন, তাতে আমরা আসলে বিব্রত হয়েছি। সবাই এ ঘটনার নিন্দা করেছেন। এ ঘটনাকে দুঃখজনক বলে অভিহিত করেছেন। দলের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে বিষয়টি লম্বা না করে সুরাহা করতে বলেছেন। ভূমি প্রতিমন্ত্রী জাবেদ সাহেবকেও অনেকে এ বিষয়ে অনুরোধ করেছেন। সবার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অভিযোগ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিই।’
কোতোয়ালি থানার ওসি জসিম উদ্দিন ঘটনার সমঝোতা ও আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুকে আটক করে লকআপের পরিবর্তে তার কক্ষে বা অন্য কক্ষে বসিয়ে রাখা প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে হ্যান্ডকাফ পরানো বা লকআপে ঢোকানোর কোনো সুযোগ নেই। এরপরও আমরা ঘটনার পর পর তাকে আটক করে নিয়ে এসেছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য। আনার পর তিনি জানিয়েছেন, তিনি (মঞ্জুরুল আলম) আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। তাই আত্মরক্ষার্থে বৈধ পিস্তল নিয়ে এসেছিলেন। ভুলে ট্রিগারে চাপ লাগায় গুলি বের হয়ে জয়নালের পায়ে লাগে। এটি ছিল অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। পরে অভিযোগকারীও অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তাই মঞ্জুরুল আলমকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।’
মতের অমিল হলে গুলি ছোড়েন মঞ্জুরুল : অভিযোগ রয়েছে, কারও সঙ্গে বনিবনা তথা কথার বা কাজের অমিল হলেই গুলি ছোড়েন মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই তার অনুসারীরাও। ১৮ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারী পার্বতী মডেল উচ্চবিদ্যালয় হলরুমে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ সালামের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ফুল দেয়া নিয়ে আরেক পক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষের একপর্যায়ে মঞ্জুরুল আলম ৫-৭ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়েন বলে অভিযোগ আছে।
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ব্যানার ছেঁড়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাটহাজারী বাসস্টেশন জিরো পয়েন্টে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইউনুচ গণি চৌধুরী ও মঞ্জুরুল আলম চৌধুরীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর মঞ্জুরুল আলমের অনুসারীরা ফাঁকা গুলি ছোড়ে ও দেশীয় অস্ত্রের মহড়া দেয়। ওই দিন সাড়ে ৭টার দিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন চৌধুরী নোমান হাটহাজারী মডেল পার্বতী উচ্চবিদ্যালয় থেকে একটি সভা শেষে বাড়ি ফেরার পথে মঞ্জুরুল আলম মঞ্জুর অনুসারীরা তার গাড়ি ভাংচুর করে এবং তাকে (সাধারণ সম্পাদক) লক্ষ্য করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে।
২২ আগস্ট রাতে উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১নং রেলগেট সইজ্যাপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হাসানের বাড়ি লক্ষ্য করে মঞ্জুর অনুসারীরা ১০-১২ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
অভিযোগ সম্পর্কে মঞ্জুর আলমের বক্তব্য : যুবলীগ নেতার পায়ে গুলি করা, সমঝোতা ও হাটহাজারীতে অপকর্মের অভিযোগ প্রসঙ্গে মঞ্জুর আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘ঝাপটা জাকির নামে একজনকে ক্লাবে নিয়ে এসেছিলেন জয়নাল। ক্লাবের শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আমি বহিরাগত কাউকে আনতে নিষেধ করেছিলাম। এরপরও ওই লোক কীভাবে এলো, তা সিকিউরিটির কাছে জানতে চাইলে জয়নাল আমার ওপর চড়াও হয়। আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। আমি গাড়ি থেকে আমার বৈধ পিস্তল নিয়ে আসি তাকে ভয় দেখানোর জন্য। কিন্তু অন্যরা তা কেড়ে নেয়ার সময় পিস্তল মাটিতে পড়ে যায়। এ সময় বুলেট বের হয়ে জয়নালের পায়ে লাগে। ঘটনার পর আমাকে থানায় যেতে বললে আমি থানায় যাই।’ তিনি বলেন, ‘এটি ছিল অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। এজন্য আমি বিবেকের তাড়নায় দুঃখ প্রকাশ করেছি। তা ছাড়া জয়নালের ভাই একজন আওয়ামী লীগ নেতা। আমিও সরকারি দল করি। সে কারণে চট্টগ্রামের মেয়রসহ জেলা ও নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সমঝোতার উদ্যোগ নেন। আমিও সেই উদ্যোগে সাড়া দিই।’
তিনি বলেন, ‘সমঝোতার জন্য পুলিশ বা অন্য কাউকে মুচলেকা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
ঘটনার সময় মদ্যপ থাকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘৭-৮ বছর আগে আমি ‘ড্রিংক’ (মদ পান) ছেড়ে দিয়েছি।’
হাটহাজারীকে অশান্ত করে তোলা ও বিভিন্ন সমাবেশে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে তিনি ও তার অনুসারীরা লিপ্ত হচ্ছেন- এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘যারা বিএনপি বা জাতীয় পার্টির সঙ্গে লিয়াজোঁ করে রাজনীতি করছে, জামায়াত-জঙ্গিকে প্রশ্রয় দিয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষতি করছে, তাদের সঙ্গে আমার ছেলেদের ঝামেলা তো হবেই। কারণ আমি তাদের কখনও মেনে নিতে পারি না, পারবও না।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন