বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কক্সবাজার সফরের পর নড়েচড়ে বসছে আওয়ামী লীগ। রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ বিতরণের এ সফরকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সফর হিসেবেই দেখছেন ক্ষমতাসীন দলটির নীতিনির্ধারকেরা। এর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বিএনপি আগামী নির্বাচনের ‘ওয়ার্মআপ’ পর্ব সেরে ফেলেছে বলে মনে করছেন তারা। নির্বাচনকে সামনে রেখে যা নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে।
অন্য দিকে কক্সবাজার যাওয়া এবং ফেরার পথে ফেনীতে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা রাজনৈতিকভাবে সরকারের ইমেজ ক্ষুণ্ন করেছে বলে মত তাদের। এ সফরের সফলতায় খালেদা জিয়া শিগগিরই আরো কয়েকটি বিভাগে সফরের পরিকল্পনা করছেন বলে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। সে জন্য বিএনপির রাজনীতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের পক্ষে তারা। এরই অংশ হিসেবে ফেনীর ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে দু’টি মামলা করেছে। এসব মামলায় বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের নাম দিয়ে ধরপাকড়ও শুরু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ স্থানীয় ছাত্রদল ও যুবদলের সাতজন নেতাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের নির্দেশনায় এসব মামলা ও গ্রেফতার অভিযান চলছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বিএনপি মাঠে নামলেই নেতাকর্মীরা আবারো হামলা-মামলা ও গ্রেফতারের শিকার হতে পারেন। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র এমন আভাস দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, বিদেশ থেকে ফিরেই খালেদা জিয়া এভাবে মাঠে নেমে পড়বেন, এটা আওয়ামী লীগ আগে থেকে আঁচ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, সরকার রোহিঙ্গা সঙ্কটসহ নানা পরিস্থিতি মোকাবেলায় কয়েক মাস ধরে ব্যস্ত আছে। এই সুযোগ নেয়ার জন্যই তড়িঘড়ি করে মাঠে নেমেছে বিএনপি। আর এ ক্ষেত্রে রাজনীতির জন্য রোহিঙ্গাদেরই বেছে নিলেন তিনি। কারণ রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে গেলে সরকার যদি বাধা দেয় তা দেশ-বিদেশে সরকারের ইমেজ ুণœ করবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক দাতা দেশগুলোও রোহিঙ্গা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।
সে জন্য খালেদা জিয়ার কক্সবাজার সফরে কোনো ধরনের বাধা দেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল না সরকারের। বরং চট্টগ্রাম বিভাগের ডিসি-এসপিরা নির্দেশনা চাইলে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার নির্দেশ দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিরোধী নেত্রীর এ সফরের ব্যাপারে বেশ ইতিবাচক ছিলেন। এর মাধ্যমে বিএনপি এবং খালেদা জিয়াকে ঘিরে নেতাকর্মীদের আগ্রহ ও অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিলেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। তবে অতি উৎসাহী হয়ে সরকারদলীয় এমপিসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশে বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেন সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা। এ অবস্থায় ফেনীতে খালেদা জিয়ার বহরে হামলার ঘটনাও ঘটে।
এতে সাংবাদিক ও নেতাকর্মীসহ অর্ধশতাধিক আহত হন। ক্ষমতাসীন দল এটিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল বলে দাবি করলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে হামলাকারী সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের ছবি প্রকাশ পায়। বিষয়টি নিয়ে বেশ ইমেজ সঙ্কটে পড়ে সরকার।
অন্য দিকে খালেদা জিয়ার সফরকে কেন্দ্র করে তৃণমূল নেতাকর্মীদের নব জাগরণ বিএনপিকে উজ্জীবিত করেছে। এ সফরের পর বেশ ফুরফুরে ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে বিএনপি, যা সরকার খুব ভালোভাবে দেখছে না। ফলে বিএনপিকে আবারো নানাভাবে চাপে রাখার কৌশল নিচ্ছেন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, বিএনপি দীর্ঘ দিন ঢাকাসহ সারা দেশের কোথাও জনসভা বা সমাবেশের অনুমতি পায়নি। এমন কি ছোটখাটো কর্মসূচিতেও অনুমতি মিলছিল না দলটির। খুব বেশি প্রকাশ্যে না এসে আত্মগোপনে ছিল নেতাকর্মীরা। সরকারের দমন-পীড়ন আর হামলা মামলায় অনেকটাই ঘরোয়া রাজনীতিতে আবদ্ধ ছিল বিএনপি ও ২০ দলীয় এ জোট। ফলে তারা খুব বেশি আলোচনায় ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে বিশাল শোডাউন করে নেতাকর্মীরা। তার ফেরার আগে কয়েকটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল এবং তিনি ঢাকায় ফিরে জামিনের আবেদন করতে যখন আদালতে যান সেখানে আসা-যাওয়ার পথেও হাজির ছিল দলের বিপুল নেতাকর্মী। দীর্ঘ দিন পর রাজধানীতে এমন শোডাউন বিএনপির মনোবল বাড়িয়ে দেয়। ফলে আরেকটি ‘এসিড টেস্ট’ হিসেবে রোহিঙ্গাকে উপলক্ষ করে ঢাকার বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন খালেদা জিয়া।
আর সরকারও বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছে। তাই কোনো বাধা দিতে চায়নি। কিন্তু এ সফরকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিনের রাজনৈতিক চিত্র সরকারকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। সে জন্য বিএনপিকে আবারো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে ফেনীতে মামলা করা হয়েছে। জ্ঞাত ও অজ্ঞাত এসব মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীদেরই কাবু করা হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে নামতে চাইলে আবারো তাদের প্রতিরোধ করা হবে।
সরকারি দলের দু’জন সিনিয়র নেতা বলেন, মনে হচ্ছে খালেদা জিয়া হিসাব করে এগোচ্ছেন। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে তার। কক্সবাজার সফরের মাধ্যমে তিনি মাঠের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়া মামলা মোকদ্দমা মোকাবেলা করার কৌশল হিসেবে দলকে চাঙ্গা করছেন তিনি। তবে আপাতত বিএনপিকে আর খুব বড় ধরনের রাজনৈতিক স্পেস দিতে চায় না সরকার। আমরা শুনেছি ঢাকা-চট্টগ্রাম সফরের পর খালেদা জিয়া নাকি অন্য বিভাগেও যাওয়ার চিন্তা করছেন। কিন্তু তাকে বখশীবাজার (বিশেষ আদালত) আর গুলশানের বাইরে খুব বেশি দূরে যেতে দেয়া হবে না।
এক নেতা বলেন, ‘দুর্নীতি মামলায় বিএনপির সাবেক দু’জন সংসদ সদস্য ইতোমধ্যে কারাগারে গেছেন। সামনে আরো অনেক বড় বড় নেতারও এ পরিণতি হতে পারে। তাই তাদের খুব বেশি খুশি হয়ে লাভ নেই।’
এ দিকে খালেদা জিয়ার কক্সবাজার যাত্রায় পথে পথে দলের নেতাকর্মীদের জমায়েত করার মাধ্যমে বিএনপিকে রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার সুযোগ দিতে চায় না আওয়ামী লীগ। সে জন্য আগামীকাল শনিবার আওয়ামী লীগেরও একটা বড় প্রতিনিধিদল কক্সবাজারে যাচ্ছে। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বর মাসে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। আগামী বছর এপ্রিলের মধ্যে গাজীপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এসব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মসূচি নিতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। বিএনপি যাতে কোনোভাবেই রাজপথ দখলে নিতে না পারে সে জন্য নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ। আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত এ অবস্থা চলবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরাও চাই বিএনপি তাদের কর্মসূচি পালন করুক। কিন্তু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে তারা বিভিন্ন সময় অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। তাদের অতীত কর্মকাণ্ডে জনগণ শঙ্কিত। এ ছাড়া দুর্নীতি ও জ্বালাও পোড়াওসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তাদের নামে মামলা মোকদ্দমা রয়েছে। এগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আদালতের বিষয়। তবে রাজপথে আবারো কোনো নাশকতা করতে চাইলে জনগণকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের প্রতিরোধ করবে। নয়া দিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন