ভয়ংকর নানা অপরাধে বেপরোয়া হয়ে উঠছে মতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ। ধর্ষণ, হত্যা, সংঘাত, দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ তাদের নানা অপরাধের ঘটনা এখন নিয়মিত হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার দাপটে তাদের নানা অপকর্ম জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করছে। দলীয় কোন্দলে ক্যাম্পাস বার বার বন্ধ হয়ে পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট করছে। আওয়ামী লীগের কোনো নেতার নামে কেউ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে তাকে ধরেবেঁধে জেলখানায় পাঠানো হয়। আর ছাত্রলীগ বড় বড় অপরাধ করে সমালোচিত হলেও পুলিশ তাদের খুঁজে পায় না। ফলে ছাত্রলীগের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।
এ বছরের প্রথম ছয় মাসে টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, পুলিশ কর্মকর্তাকে মারধর, শিক লাঞ্ছনা, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, খুনসহ ৩৭টি ঘটনায় ছাত্রলীগ গণমাধ্যমের সংবাদ হয়েছে। যার মধ্যে ১২টি ঘটনার সঙ্গে আধিপত্য বিস্তার ও আর্থিক বিষয় জড়িত। এছাড়া নারী সংক্রান্ত কেলেংকারি তো রয়েছেই। বছর শেষে এসব অপরাধমূলক কর্মকান্ড কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে বেশ আলোচনার ঝড় তুলেছে শরীয়তপুরে ছাত্রলীগ নেতা হোসেন হাওলাদারের ৬ নারীকে ধর্ষণ এবং সেই ভিডিওচিত্র ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন হাওলাদার ফাঁদে ফেলে স্থানীয় ৬ নারীকে ধর্ষণ করে সেই ভিডিওচিত্র ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়।
উপজেলা ছাত্রলীগ ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ভেদরগঞ্জ উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফ হোসেন হাওলাদার গোসলখানায় গোপন ক্যামেরা রেখে স্থানীয় এক নারীর ভিডিও ধারণ করে। পরে সেই ভিডিও প্রকাশ করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ওই নারীকে ধর্ষণ করে। গত ১৫ অক্টোবর থেকে এ সকল ভিডিও মোবাইলের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে আরিফ। লোকলজ্জার ভয়ে ভুক্তভোগী নারীরা মুখ খুলতে রাজি হচ্ছে না। আবার কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। এক নারীকে শ্বশুর বাড়ির লোকজন তার বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এরমধ্যে আরিফ তার চাচাত বোন এবং এক মালয়েশিয়া প্রবাসীর স্ত্রীকে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, অশ্লীল ভিডিও দেখিয়ে সে অনেক নারীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মোবাইলের মাধ্যমে এ সকল অশ্লীল ভিডিও দেখে মানুষের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
: এখানেই ছাত্রলীগ নামধারীদের অপকর্মের শেষ নয়। বরগুনার পাথরঘাটা কলেজে অজ্ঞাত এক তরুণীকে ধর্ষণ শেষে হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন ছাত্রলীগের চার নেতা- কলেজ শাখার সভাপতি রুহি আনান দানিয়াল (২২), সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন (২১), ২ নম্ব^র সাংগঠনিক সম্পাদক মাহিদুল ইসলাম রায়হান (১৯) ও উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক মোহাম্মদ মাহমুদ (১৮)। গত ১০ আগস্ট পাথরঘাটা কলেজের পেছনে খাস পুকুর থেকে হাত-পা বাঁধা অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়।
: চলতি বছরের গত ১৭ জুলাই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সিলেটের বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে ছাত্রলীগের পল্লব ও পাভেল গ্রুপের সংঘর্ষে খালেদ আহমদ লিটু নামে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ১২ এবং ১৩ জুলাই চট্টগ্রাম কলেজে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী ছাত্রলীগের দু পরে মধ্যে মারামারির ঘটনায় প্রকাশ্যে গোলাগুলি হয়। অস্ত্রধারী যুবকের ছবি প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে। গত জুলাই মাসে সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রলীগের দুই পরে বিরোধের জের ধরে ছাত্রাবাসের ৩৯টি ক ভাঙচুর করা হয়। ছাত্রলীগের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন। যারা অপরাধে সংশ্লিষ্ট তাদের কাউকে কাউকে সাময়িক বহিষ্কার করার ঘটনাও আছে। তবে সময় গড়িয়ে যাওয়ার পর দেখা যায়, অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে রয়েছে। এর আগে অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে। দুজনের বিলাসী জীবন, টাকার ভাগাভাগি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ এবং কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও থেকে যাওয়া নিয়ে। অভিযোগ উত্থাপন করেছেন সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
এ নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। সারাদেশে ছাত্রলীগের অনিয়ন্ত্রিত অপকর্ম নিয়ে ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের প থেকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হলেও সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কোনো ভ্রƒপে করছে না। বরং দিন দিন তাদের অপকর্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার যেন কেউ নেই। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, পুলিশ কর্মকর্তাকে মারধর, শিক লাঞ্ছনা, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, খুনসহ ৩৭টি ঘটনায় ছাত্রলীগ গণমাধ্যমের সংবাদ হয়েছে। যার মধ্যে ১২টি ঘটনার সঙ্গে আধিপত্য বিস্তার ও আর্থিক বিষয় জড়িত। এছাড়া নারী সংক্রান্ত কেলেংকারি তো রয়েছেই। এসব অপরাধমূলক কর্মকান্ডে সংগঠনটির ভাবমর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই।
: ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে পড়ে নিহত হয় দরিদ্র দিনমজুরের ছেলে আবু বকর। গত সাত বছরেও সেই হত্যার বিচার হয়নি। ফরিদপুরের গরিব অটোরিকশাচালকের ছেলে হাফিজুর মোল্লাকে সলিমুল্লাহ হলে জীবন দিতে হলো ছাত্রলীগের মধ্যরাতের তালিম নিতে গিয়ে। তিনি নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন। তারপরও শীতের রাতে ছাত্রলীগের এক নেতা তাকে ‘সাংগঠনিক কাসে’ হাজির হতে বাধ্য করেন। এ রকম অনেক অনেক অঘটন ঘটিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কর্মী জুবায়েরকে হত্যা করে ছাত্রলীগের প্রতিপ গ্রুপ। প্রতিপ গ্রুপের হাতে আরও ছাত্রলীগ কর্মী খুন হয়েছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন শিক, প্রক্টর।
এমনকি তারা রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এ কে এম নূর-উন-নবীকে ১৪ ঘণ্টা তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখতেও দ্বিধা করেননি। পরে পুলিশি প্রহরায় তিনি বাসায় ফিরেছেন। তার ‘অপরাধ’, ছাত্রলীগের নেতাদের চাকরি দেননি। : ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ‘জুতা চুরির’ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয়ে গ্রুপের ১০ জনের মতো আহত হয়। এরপরের বছর জুন মাসে মিরপুরের একটি মেস থেকে কয়েক শ জুতাসহ ছাত্রলীগের দুই নেতাকে আটক করে পুলিশ। মসজিদ থেকে এসব জুতা চুরি করা হত বলে জানা যায়। জুতা ছাড়াও ফেনসিডিল, ইয়াবা ও অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়। : ঠুনকো বিষয় নিয়েও তাদের মধ্যে মারামারি হয়। গত বছর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) বিজয় দিবসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের তুমুল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
দিনকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন