ওয়ান ইলিভেনের পর সেনাসমর্থিত ফখরউদ্দীন-মঈনউদ্দীন সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বিনা ওয়ারেন্টে তথাকথিত মামলার আসামি করে তারেক রহমানকে ঢাকা ক্যান্টমেন্টস্থ মইনুল রোডের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে যৌথবাহিনী। পরে বেগম খালেদা জিয়া ও আরাফাত রহমান কোকোকেও গ্রেপ্তার করে যৌথ বাহিনী।
সেদিন অনেকটা নাটকীয়ভাবেই বেগম খালেদা জিয়ার সামনে থেকে তারেক রহমানকে জোর করেই তুলে নিয়েছিল যৌথ বাহিনী।
গুলশান থানায় তথাকথিত এক কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে ব্যবসায়ী আমিন আহমেদ চৌধুরীর দায়ের করা মামলায় প্রথমে তাকে চার দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়। পরে ছয় দফায় ১৩ দিন রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন আদালত।একেক করে তার বিরুদ্ধে মোট ১৩ টি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়।
৭ মার্চ গভীর রাতে, তারেক রহমান এক স্বজনকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘ওরা আমাকে নিতে এসেছে। আমি কোনো অপরাধ করিনি, আমার জন্যে দোয়া করবেন।’
রাতভর নানা নাটকীয়তার পর ভোরে মা বেগম খালেদা জিয়ার অঝোর কান্না আর প্রতিবাদের মধ্যেই তারেককে নিয়ে যায় যৌথ বাহিনী। ১৩ টি মামলায় জামিন পাওয়ার পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। কিন্তু তারেক রহমান তখন আর সুস্থ নেই। অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে স্ট্রেচারে গিয়ে লন্ডনের প্লেনে উঠেছিলেন ১১ সেপ্টেম্বর। ৫৫৪ দিন কারাবাসের পর লন্ডনে যাওয়ার আগে পিজি হাসপাতালে মায়ের সঙ্গে দেখা হয়। কান্নায় ভেঙে পড়া মায়ের বুকে বেদনার্ত তারেকের রোদন ও বাষ্পরুদ্ধ কথোপকথন পিজি হাসপাতালের বাতাসকে ভারি করে তুলেছিল।
তারপর থেকে তারেক লন্ডনে, চিকিৎসায়। আগের চাইতে এখন খানিকটা সুস্থ। কিন্তু কোনোদিনই সম্পূর্ণ সুস্থ হবেন না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। সারাক্ষণই শরীরে যন্ত্রণা হয়। তার মেরুদণ্ডের ভেঙে যাওয়া হাড়টা জোড়া লেগেছে বাঁকা হয়ে।
ডাক্তাররা বলেছেন, সম্পূর্ণ আরোগ্য কখনওই সম্ভব নয়। সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার ফিজিওথেরাপি নেন। আরও চিকিত্সা দরকার।
বেদনার্ত অতীতকে খুঁড়ে তুলতে, স্মরণে আনতে বিমর্ষ তারেকের বেশ অনীহা। তবু সম্প্রতি এক সাংবাদিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘২০০৭-এর ৩১ ডিসেম্বর রিমান্ডে থাকাকালে আমার ওপর নানা রকমের দৈহিক নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল অনেক উপর থেকে বার বার ফেলে দেয়া।’
‘অসহ্য যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে উঠেছি। কিন্তু ওইসব অফিসারের বিন্দুমাত্র মায়া-দয়া হয়নি।ওদের দায়িত্ব ছিল আমাকে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় আমি কারাগারে। কোনো ডাক্তার নেই। চিকিৎসা হয়নি। প্রতিটি দিন কেটেছে নারকীয় যন্ত্রণায়।একজন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, গ্রেপ্তার চলতে পারে। কিন্তু নির্যাতন করার, শরীরের অঙ্গ বিকল করার,মানবাধিকার পদদলিত করার অধিকার সভ্যতার কোথায় আছে?’
রিমাণ্ডের নামে তার ওপর চালানো হয় নির্মম, পৈশাচিক ও বর্বর নির্যাতন।তরতাজা যু্বককে করা হলো পঙ্গু।দীর্ঘ ১৮ মাস ধরে তাকে কারাগারে আটক রাখা হয়। নির্যাতনকে ধামাচাপা দিতে তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী ২০০৭ সালের ২৫ আগস্ট খবর ছড়িয়ে দিল যে তারেক রহমান তার হাসপাতাল কক্ষে পা পিছলে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছেন। এরপর খবরের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয় ও ধারণা সৃষ্টি হয় যে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনকে গোপন করার লক্ষ্যে এই খবর ছড়ানো হয়।
এতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওই সময় বিক্ষোভ দেখা দেয়, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অথচ আসলেই খবরটা ছিল মইন ফখরুদ্দীনের একটি চাল মাত্র।
যা থেকে মানুষকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিল তারেক রহমান কে কোনো রকম নির্যাতন করা হয়নি। কিন্তু ততদিনে দেশের মানুষ বুঝে গিয়েছিল শাসক গোষ্ঠী একজন তরতাজা টগবগে যুবক কে অকথ্য নির্যাতনের মাধ্যমে তার জীবনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
সবগুলা মামলাই মিথ্যে প্রমাণিতত হয়ে ১৩ টি মামলাতেই জামিন পাওয়া পর দীর্ঘ ১৮ মাস পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। ১১ সেপ্টেম্বর অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে চলে যান লন্ডনে চিকিৎসার জন্য। এখনও তিনি লন্ডনে চিকিৎসাধীন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। মেরুদণ্ডের ভেঙে যাওয়া হাড়টা জোড়া লেগেছে বাঁকা হয়ে। সেই ওয়ান ইলিভেন থেকেই শুরু হয় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার, যার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে বলে দাবি বিএনপির।
বর্তমানে তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে অর্ধ শতাধিক মামলা ঝুলছে। তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন। বর্তমানে লন্ডনের সাউথ ওয়েলিংটন ও লন্ডন হসপিটালে তারেক রহমানের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসার সুবিধার্থে তিনি সেন্ট্রাল লন্ডনের এডমন্টনে সপরিবারে বাস করছেন।
প্রসঙ্গত, সরকার বিরোধী আন্দালনের মধ্যেই গেল ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো নির্বাসনে থাকাবস্থায় মারা যান। পরদিন কোকোর লাশ গুলশান অফিসে আনা হলে খালেদা জিয়া কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।লাখো মানুষের শ্রদ্ধা-ভালবাসায় ২৭ জানুয়ারি কোকোর লাশ দাফন করা হয়।
এছাড়া ২০০৯ সালের মে মাসে ৪০ বছরের স্বামীর স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি ছাড়া হয়ে উঠেছেন ভাড়া বাসায়। সেদিনও খালেদা জিয়া অঝোরে কেঁদেছেন খালেদা জিয়া।
এসব স্মৃতি বেগম খালেদা জিয়াকে আজও কাঁদায়। প্রতিবছর ছোট ছেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদেন বেগম জিয়া। এসব স্মৃতি যেন কোনোভাবেই ভুলে যাবার নয় খালেদা জিয়ার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন