বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে দীর্ঘকাল ধরে নির্দলীয় ধর্মচর্চার সংগঠন হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে তাবলিগ জামাত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের নেতৃস্থানীয়দের ‘দোষারোপের রাজনীতির’ কারণে সংগঠনে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজধানীর কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের একাধিক পক্ষের মধ্যে একাধিকবার বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা, এমনকি মারামারিও হয়েছে। এসবের কারণে আসন্ন বিশ্ব ইজতেমায় এবার বিপুলসংখ্যক মুসল্লির জমায়েত নিয়েও খানিকটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তাবলিগ জামাতের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানিয়েছে, এখন বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতকে একাধিক ভাগ করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এর ফলে ছোটখাটো ঘটনায় কয়েকটি কুচক্রী মহল বিভেদ তথা সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা করছে। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মানুষের ভালোবাসার কারণে এত দিনেও কেউ এই জামাতের মধ্যে প্রকাশ্যে বড় ধরনের কোনো সংঘাত দেখেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাবলিগ জামাতের মুরব্বি মাওলানা সাদ সাহেবের অনুসারী ওয়াসি উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যারা দুনিয়াবি সুবিধা পেতে চায় তারাই ঝামেলা পাকাচ্ছে। আদতে তাবলিগ জামাতের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। নিরহংকার হয়ে ধর্মের জন্য জানমাল আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দেওয়ার নামই তাবলিগ জামাত বা ধর্ম প্রচার করা। কিন্তু যারা এই আদর্শ নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি তারাই সংঘাতের পথে যাচ্ছে।
’
এদিকে আরেক মুরব্বি মাওলানা যোবায়ের (রহ.)-এর অনুসারী মাওলানা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তাবলিগ জামাতে লাখো মানুষ বিনা প্রচারে দ্বিনের জন্য, ধর্মের জন্য আল্লাহর রাস্তায় খরচ করছে। তাই এখানে মুরব্বিদের কাছে খরচ চাওয়ার বা হিসাব চাওয়ার কোনো বিষয় নেই। আর এ বিষয় নিয়ে আগে কখনো কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এখন কেন এ বিষয়ে মুরব্বিদের প্রশ্ন করতে হবে?’
মাওলানা আব্দুল্লাহ আরো বলেন, ‘তাবলিগ যারা করছে তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশই হলো মহান আল্লাহ তায়ালাকে রাজি ও খুশি করা। আমাদের ওপর আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ পুরোপুরি প্রতিপালন করা। কিন্তু কেউ যদি এই দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে দুনিয়াবি কাজ নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায় তবে তারা হবে দুনিয়ার বুকে বিভেদ সৃষ্টিকারী। ’
তাবলিগের সূত্রগুলো জানায়, নির্দলীয় সংগঠন হিসেবে তাবলিগে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দেওয়া বা নেওয়ার সুযোগ নেই। সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে চলে আল্লাহর পথে দেওয়া সময়কে কাজে লাগানোতেই বেশি সওয়াব মনে করছেন মুরব্বিরা। তবে ইদানীং যেসব ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে কোনো পক্ষই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ।
যারা প্রতিবাদী হয়ে উঠছে তাদের অভিযোগ, কাকরাইলের মারকাজে বিভিন্নভাবে আসা সাহায্যের বিষয়ে কোনো হিসাব দিচ্ছেন না মুরব্বিরা। আর তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি করে ফেলেছেন।
ওই পক্ষ বলছে, মুরব্বি মাওলানা ওয়াসিফ দীর্ঘদিন ধরে শুরা সদস্য আছেন। তিনি আর কাউকে শুরায় নিচ্ছেন না।
অন্য পক্ষ বলছে, মাওলানা ওয়াসিফ পারিবারিকভাবে ধনাঢ্য ব্যক্তি। তাঁর ছেলেরা রাজধানীর খিলগাঁওয়ে খিদমাহ হাসপাতাল করেছেন। তা ছাড়া তাঁদের ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি নতুন কিছু নয়।
তাবলিগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এভাবে ছোটখাটো বিষয় থেকেই সমস্যার সূত্রপাত। তাই এখনই এসব সমস্যার মূলোৎপাটন করতে হবে মুরব্বিদের।
ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ তীরে আগামী ১২ থেকে ১৪ জানুয়ারি এবং ১৯ থেকে ২১ জানুয়ারি দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে নিরাপদ ও সুষ্ঠুভাবে ইজতেমা আয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাবলিগ জামাতের মুরব্বিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশ সদর দপ্তরে এ বৈঠক হয়।
বৈঠক শেষে পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ বিভাগের এআইজি সহেলী ফেরদৌস জানান, বিশ্ব ইজতেমা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে পুলিশ, র্যাব, আনসার ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক আর্মড পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ও গাজীপুর জেলা পুলিশ ইজতেমা ও আশপাশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে। স্থাপন করা হবে ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম।
এদিকে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে গত শুক্রবার শুরু হওয়া পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা চার দিনেই সমাপ্ত ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ময়দানের শীর্ষ মুরব্বিদের জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সোমবার বাদ আসর কাকরাইল মসজিদের ইমাম মাওলানা জোবায়েরের আখেরি মোনাজাত পরিচলানার মধ্য দিয়ে এ জোড় ইজতেমা সমাপ্ত হয়।
ইজতেমা ময়দানের মুরব্বি গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘অনিবার্য কারণে এক দিন আগেই এবারের জোড় ইজতেমা সমাপ্ত করা হয়েছে। ’ এর বাইরে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
এ ঘটনাকে তাবলিগের মুরব্বিরা সাধারণ ঘটনা বললেও একাধিক সূত্র বলছে, ইজতেমা ময়দানের শীর্ষ দুই মুরব্বির অনুসারীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে জোড় ইজতেমা এক দিন সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মুরব্বি মাওলানা মাহফুজুল হান্নান দাবি করেন, ইজতেমা ময়দানে অভ্যন্তরীণ কোনো কোন্দল নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাওলানা ওয়াসি উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জোড় ইজতেমা এর আগেও নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ হওয়ার নজির রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে তা আগানো যেতে পারে। তাই বলে সোমবারে শেষ হওয়া টঙ্গীর জোড় ইজতেমাকে সেভাবে বলা যাবে না। ’
বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের দুটি পক্ষের বিরোধের জেরে অস্থিরতা নিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানীতে আলোচনা-সমলোচনা চলছে। সংকট নিরসনে প্রথমবারের মতো সংগঠনটির পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে পাঁচজন কওমি আলেমকে।
গত ১৬ নভেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া মাদরাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে কাকরাইল মারকাজের শুরার ১০ সদস্য ও কওমি আলেমদের পাঁচজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে তাবলিগ জামাতের সংকট নিরসনে ও নিরপেক্ষ ধর্মপ্রচারে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ নভেম্বর সকালে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাবলিগ জামাতের মজলিশে শুরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম ও হাফেজ মাওলানা জুবায়েরের পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয় কাকরাইল মসজিদে। এরপর তা সংঘর্ষ ও ভাঙচুরে রূপ নেয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন