ভালুকার এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ দেওয়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী একঝাঁক শিক্ষার্থী।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে যেন পুরো উপজেলায় উৎসব চলছে। একটি-দুটি নয়, সাড়ে চার শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মাঝে চলছে এই ভাষণ শেখার প্রতিযোগিতা।
স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তির সনদ হিসেবে পরিচিত এই ভাষণ সারা দেশের গুটিকয়েক মানুষই মুখস্থ বলতে পারে। সেখানে জাদুকরী সেই ভাষণ এখন উপজেলার দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর মুখস্থ।
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার গ্রামে গ্রামে চলছে কোমলমতি শিশুদের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মুখস্থ করে জাতির জনকের মতো অঙ্গভঙ্গির মধ্য দিয়ে উচ্চারণ করা এবং মুজিব কোট পরে যেন পুরোদস্তুর বঙ্গবন্ধু সাজার চেষ্টা চলছে শিশুদের মধ্যে। সে সুবাদে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পাঁচ থেকে ১০ জন করে শিক্ষার্থী তা পুরোপুরি রপ্ত করে ফেলেছে। এর মধ্যে উপজেলার হালিমুন্নেছা মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে। এ প্রতিষ্ঠানের চার শতাধিক শিক্ষার্থী বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মুখস্থ বলতে পারে।
উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌর এলাকার চার শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭ই মার্চের ভাষণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বেছে নেওয়া হয়েছে সেরা ভাষণদাতাকেও।
ভালুকা উপজেলার প্রতিটি গ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশুদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগিয়ে তোলার কাজটির নেপথ্যের কারিগর এখানকার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল আহসান তালুকদার।
তিনি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শিশুদের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেখানোর উদ্যোগ নেন। এর জন্য উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য ভাষণের প্রায় ১২০০ কপি সিডি এবং প্রিন্ট কপি দেওয়া হয়। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজন করেন মাসব্যাপী ভাষণ প্রতিযোগিতার। প্রথমে নিজ স্কুলে এবং পরে ইউনিয়নভিত্তিক সেরা হওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। চারটি বিভাগে উপজেলার সেরা ভাষণদাতা হিসেবে ১২ জনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে। আগামী ২৫ নভেম্বর শনিবার উপজেলা সদরে জাঁকজমকপূর্ণভাবে বিশাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওই সব সেরা শিশুর হাতে পুরস্কার ও ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হবে।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেখানোর জন্য এর পূর্ণাঙ্গ সিডি সংগ্রহ করে সেটির কপি ও প্রিন্ট কপি উপজেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয়। প্রতিযোগিতার জন্য ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে গঠন করা হয় বিচারক প্যানেল। শিক্ষার্থীরা বারবার ওই সিডি দেখে বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের ভাষণটি শোনা, বোঝা ও মুখস্থ করার চেষ্টা চালায়। অবশেষে ভাষণটি প্রদানকালে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গভঙ্গি, তিনি ভাষণের সময় কোথায় কতবার হাত ওপরে তুলেছেন বা পেছনে নিয়েছেন, ভাষণে তাঁর কথা বলার ভঙ্গি, পরিহিত পোশাক অনুকরণ করে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা। এমনকি ভাষণের কোথায় তিনি আঞ্চলিক, কোথায় শুদ্ধ ভাষার ব্যবহার করেছেন, শিক্ষার্থীরা সেটিও রপ্ত করে এবং হুবহু বঙ্গবন্ধুর মতো করে বলার চেষ্টা করে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক এবং পরে ইউনিয়নভিত্তিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে একজন করে প্রতিযোগী বাছাই করা হয়। অবশেষে অনুষ্ঠিত হয় উপজেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। এতে চারটি বিভাগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী হিসেবে ১২ জনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়।
হালিমুন্নেছা মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানজিনা আক্তার বলল, ‘প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে জাতির জনকের ভাষণটির প্রেমে পড়ে গেছি। এখন আমি প্রায় বঙ্গবন্ধুর মতো করেই ভাষণটি আউড়ে যেতে পারি। ’ তানজিনার বাবা মোশারফ হোসেন বলেন, ‘ভাষণটি প্রতিবছর ৭ই মার্চ মাইকে ও টেলিভিশনে শুনি। এখন আমার ঘরে মেয়ের মুখে প্রায়ই শুনি। ভাষণটি যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক। ’
উপজেলা পর্যায়ে মাধ্যমিক বিভাগে প্রথম হয়েছে হালিমুন্নেছা স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাজিয়া খাতুন। ওর অভিব্যক্তি, ‘বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতাম না। ভাষণটি শেখার মাধ্যমে অনেক কিছুই জেনেছি। কিভাবে তিনি আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন এবং অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। এখন ছোট ভাই-বোনদের ভাষণটি শেখাচ্ছি, প্রতিবেশী শিশুদেরও শোনাই। ’ রাজিয়ার বাবা শামিম আহাম্মেদ বলেন, ‘রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চের সেই মহাসমাবেশ নিজের চোখে দেখতে পারিনি। সরাসরি শোনার সৌভাগ্য হয়নি বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ। কিন্তু এখন আমার মেয়ে শত শত মানুষের সামনে হুবহু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বলে সেরা হয়েছে। এটা আমার জীবনের সেরা আনন্দ। ’
হালিমুন্নেছা মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা আনোয়ারা নীনা বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১২০০। প্রতিটি ক্লাসেই ভাষণ নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়েছে। আমার খুবই ভালো লাগছে যে এই স্কুলের চার শতাধিক শিক্ষার্থী বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মুখস্থ বলতে পারে। ওদের অনেকেই আবার বঙ্গবন্ধুর মুজিব কোট পরে ওনাকে অনুকরণ করে ভাষণটি বলতে পারে। ’
উপজেলার পাড়াগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উৎসবকে কেন্দ্র করে উপজেলার গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে। আমার প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ভাষণটি মুখস্থ করে ফেলেছে। এভাবে ওদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গড়ে উঠবে এবং ওদের মধ্য থেকেই আগামী দিনের নেতৃত্ব উঠে আসবে। ’
ভালুকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশেক উল্যাহ চৌধুরী বলেন, ‘ভাষণ শেখার জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি সিডি দেওয়া হয়েছিল। পরে সেটি থেকে ওরা কয়েক শ কপি করে নেয়। আমার প্রতিষ্ঠানের ১৮০০ শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই কমবেশি মুখস্থ বলতে পারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। আর প্রতিযোগিতাটি অভিভাবকরাও খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আমার স্কুলের এক শিক্ষার্থী উপজেলায় দ্বিতীয় সেরা হয়েছে। আর এখন শিক্ষার্থীরা ভাষণ শিখে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। ’
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ মাস্টার বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি সারা দেশের কতজনের মুখস্থ আছে জানি না। তবে এটা বলতে পারি, আমাদের উপজেলায় শত শত শিক্ষার্থী তা অনায়াসে মুখস্থ বলতে পারে। ’
ভালুকা উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমার উপজেলায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশুরা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বলতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত এসব শিশুই আগামী দিনে নেতৃত্বে আসবে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের ২৫ নভেম্বর বিশাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হবে। ’
উপজেলার শিশুদের বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শেখানোর কারিগর সেই ইউএনও কামরুল আহসান তালুকদার সম্প্রতি বদলি হয়ে যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এ উদ্যোগ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় ‘পয়েট অব পলিটিকস’। তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, ধর্মনিরপেক্ষতা—সর্বোপরি স্বাধীনতার সব উপাদান একসঙ্গে গাঁথা ছিল। এটিকে জাতীয় ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি এবং ৭ই মার্চকে জাতীয় ভাষণ দিবস হিসেবে ঘোষণার জন্য ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মাধ্যমে জানুয়ারি মাসেই একটি প্রস্তাবও পাঠিয়েছিলাম। ” তিনি বলেন, ‘ভাষণটি শিশুরা নিজের মধ্যে ধারণ করলে আমাদের নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারবে বঙ্গবন্ধু ভাষণটি কেন দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস শিশু-কিশোরদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। এখন অনেক ভালো লাগে যখন দেখি উপজেলায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ভাষণটি মুখস্থ বলতে পারে। একই সঙ্গে তারা জেনেছে যে কেন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আরো খুশির বিষয় হলো, ভাষণটিকে ইউনেসকো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন