রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনে প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলেই চাপা ক্ষোভ ও বিদ্রোহ রয়েছে। জাতীয় পার্টির (জাপা-এরশাদ) বিদ্রোহের কারণ চারটি। সেগুলো হচ্ছে পারিবারিক আবেগ, বঞ্চনা, নেতৃত্বের আকাক্সক্ষা ও দলের ভেতরে একাধিক নেতার মেয়র প্রার্থী মোস্তফাকে ওপরে উঠতে না দেওয়ার চেষ্টা। দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এসব কারণ জানা যায়। বিএনপিতে বিদ্রোহের কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে যোগ্য মেয়র প্রার্থী সংকট ও তরুণ নেতৃত্বকে যথাযথ মূল্যায়ন না করা। আর মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার চাপা ক্ষোভ আছে আওয়ামী লীগে। এ কারণে দল মনোনীত মেয়র প্রার্থীর পাশে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ থাকার অঙ্গীকার করলেও পুরোপুরি মাঠে নামেননি নেতারা।
জাতীয় পার্টির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের ভাষ্য, জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার রংপুর-১ আসনের (গঙ্গাচড়া) এমপি ছিলেন। এ ছাড়া জেলা জাপার আহ্বায়কসহ একাধিক পদ দীর্ঘদিন তার দখলে ছিল। এরশাদের ভাতিজা হিসেবে দলের একটি অংশ সব সময় তার পক্ষে ছিল। তাই আসিফ আশা করেছিলেন, তার চাচা দলের চেয়ারম্যান এরশাদ রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে তাকেই মনোনয়ন দেবেন। কিন্তু এরশাদ দলের প্রার্থী হিসেবে মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাকে মনোনয়ন দেন। আসিফ দলের চেয়ারম্যানের এ সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু করলে এরশাদ কিছু দিন আগে আসিফকে জেলা কমিটি থেকে অব্যাহতি দেন। নির্বাচন থেকে সরে না এলে তার সাধারণ সদস্য পদও বাতিল করা হবে বলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তাই আশা ভঙ্গ এবং বঞ্চনার ফলে পরিবারের সদস্য হিসেবে আসিফ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
জাপার কেউ কেউ মনে করছেন, এরশাদের অবর্তমানে পরিবারের পক্ষ থেকে রংপুরে দলের হাল ধরার কেউ নেই। পরিবারের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার আকাক্সক্ষা থেকেই অসিফ বিদ্রোহ করেছেন। সে কারণে এরশাদের ঘনিষ্ঠ দু-একজন আসিফের বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছেন। দলের বঞ্চিত অনেক নেতাকর্মীই আসিফের পক্ষে কাজ করছেন বলে দাবি করেছেন আসিফ।
এ ছাড়া আসিফ এক সময় গঙ্গাচড়া আসনের এমপি ছিলেন। বর্তমানে গঙ্গাচড়া আসনের এমপি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা। আগামী নির্বাচনে আসিফ গঙ্গাচড়া আসনের টিকিট পাবেন কিনা এ নিয়েও অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। অনেক ভোটারের মুখে বলতে শোনা গেছে, গঙ্গাচড়া আসনটি নিষ্কণ্টক রাখতেই আসিফকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামিয়ে ব্যস্ত রাখা হয়েছে, যাতে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে গঙ্গাচড়া আসন নিয়ে আসিফ মাথা না ঘামান। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, জাপার একাধিক নেতা মনেপ্রাণে চাচ্ছেন না মোস্তফা সিটি করপোরেশনের মেয়র হোক। সেই মহলটির ইঙ্গিতেই আসিফ নির্বাচন করছেন, যাতে জাতীয় পার্টির ভোট ভাগাভাগি হয় এবং মোস্তফা হেরে যান।
এ ব্যাপারে জাপার মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই। আসিফ জাতীয় পার্টির ভোটে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবেন না।
আসিফ শাহরিয়ার জানান, আমি আশা করেছিলাম পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি মনোনয়ন পাব। কিন্ত আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। আমি দীর্ঘদিন থেকে জাতীয় পার্টি করছি। দলের ভেতরে আমার ইমেজ রয়েছে। আমি সেই ইমেজকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি।
এদিকে বিএনপির একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দলের বিদ্রোহী প্রার্থী জেলা যুবদলের সভাপতি নাজমুল আলম নাজু ছাত্রাবস্থা থেকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তরুণ নেতৃত্ব রাজনীতিতে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেবে এমন আশায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন নাজু। তাই তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। ছাত্রদল ও যুবদলের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ তার পাশে রয়েছে বলে একাধিক নেতা দাবি করেছেন। তরুণ নেতাকর্মীরা নাজুর পক্ষে কাজ করলে ভোটের বাজারে তারুণ্য সংকটে পড়বে দলটি।
নাজমুল আলম নাজু বলেন, দীর্ঘদিন থেকে রাজনীতি করি। জেল-জুলুম সহ্য করেছি। মেয়র পদে মনোনয়ন আমার প্রাপ্য ছিল। কিন্তু দল আমাকে বঞ্চিত করেছে। দলের অনেক নেতাকর্মীই আমাকে পছন্দ করে। তাদের ভরসাতেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছি।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা বলেন, আমি ২০১২ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ২০ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছি। দলের হাইকমান্ড আমাকে যোগ্য মনে করেই মনোনয়ন দিয়েছে।
রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা দলীয় মেয়র প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর পক্ষে কাজ করে নৌকা মার্কাকে বিজয়ী করার অঙ্গীকার করলেও এখন পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে তেমন কোনো নেতাকে দেখতে পাননি কর্মীরা। ফলে একটি সংশয় থেকেই যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামবে তো। আওয়ামী লীগ নেতাদের একটু গড়িমসিতে ভোটের হাওয়া অন্যদিকে ঘুরে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেক নেতাকর্মী। তাদের আশঙ্কা, দলের নেতারা বিশেষ করে মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা নিজেদের উজাড় করে মাঠে না নামলে ফল বিপরীত হতে পারে।
তবে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি ম-ল সংশয় নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ঝন্টু তথা নৌকা মার্কার পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতারা রয়েছেন এবং থাকবেন। নৌকা মার্কার বিজয়ের জন্য তারা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবেন।
নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, সিটির ১৯৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১২৮টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ছাড়া ৩টি কেন্দ্রে এখনো বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। এখানে বিকল্প আলোতে ভোট গণনা করা হবে। এ ছাড়া ৩৮টি কেন্দ্রে যাতায়াতের জন্য পাকা সড়ক নেই। গ্রামীণ মেঠোপথ ধরেই এসব কেন্দ্রে ভোটাররা ভোট দিতে যাবেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন