নাইমুল কথা রাখেনি। সে ফিরে আসতে পারেনি তার স্ত্রীর কাছে। বাংলার বিশাল প্রান্তরের কোথাও তার কবর হয়েছে। কেউ জানে না কোথায়। এ দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার কবরের মধ্যে তারটাও আছে। তাতে কিছু যায় আসে না।
বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানকে ধারণ করেছে। জোছনার রাতে সে তার বীর সন্তানদের কবরে অপূর্ব নকশা তৈরি করে। গভীর বেদনায় বলে, আহারে! আহারে! (জোছনা ও জননীর গল্প: হুমায়ূন আহমেদ)
৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বহু দামে কেনা আমাদের স্বাধীনতা। লাল সবুজের প্রিয় বাংলাদেশ। স্বাধীনতার এই ৪৬ বছরে বহু অর্জন বাংলাদেশের। সমালোচকদের ভুল প্রমাণ করে আজ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে আমাদের মাতৃভূমি। প্রিয় বাংলাদেশ, জনসংখ্যা বেড়েছে দুই গুণেরও বেশি। কিন্তু মানুষের ক্ষুধা মুক্তি ঘটেছে বহুলাংশে। একসময় সামান্য ক’টা ভাতের অভাবে কত হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস শোনা যেত। সেদিন পেরিয়ে এসেছি আমরা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন শুধু গল্প নয়, বাস্তবতা। নানাসময় বাংলাদেশের নীতির সমালোচনা করা বৃটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টও সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে লিখেছে, অর্থনীতিতে স্থিতি এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। নীতি-নির্ধারণ অনেক বেশি স্থিতিশীল হতে পেরেছে। সরকার বিপুল পরিমাণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং সড়ক নির্মাণ করতে পেরেছে। গত এক দশকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ শতাংশ স্থির থেকেছে এবং সামনের বছরগুলোতে এই প্রবৃদ্ধির হার ধীরে ধীরে শতকরা প্রায় ৭ ভাগে উন্নীত হওয়ার
পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হয়েছে। শিশু মৃত্যু হারের মতো কতিপয় উন্নয়ন সূচক ভারতের চেয়ে লক্ষণীয়ভাবে ভালো। হেনরি কিসিঞ্জার একদা যে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সেই ধারণার অবসান ঘটেছে। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচনাও করেছে দ্য ইকোনমিস্ট।
মধ্যম আয়ের দেশের দরজায় কড়ানাড়া বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন এক হাজার ৬১০ মার্কিন ডলার। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে যা ছিল মাত্র ১২৯ মার্কিন ডলার। মাথাপিছু আয় বাড়ার পাশাপাশি সব সামাজিক সূচকেও উন্নতি করছে বাংলাদেশ। অবকাঠামো ক্ষেত্রেও অর্জন করেছে বিশাল সাফল্য। তবে অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি সমাজে বৈষম্যও বেড়েছে। এক শ্রেণির মানুষের হাতে বন্দি বেশির ভাগ সম্পত্তি। ব্যাংকিং খাতে রীতিমতো লুটপাট হয়েছে। একের পর এক কেলেঙ্কারিতেও টনক নড়ছে না নীতিনির্ধারকদের। বিদেশে অর্থ পাচার পরিণত হয়েছে মামুলি ঘটনায়। রাষ্ট্রের প্রকৃত নায়কেরা খুব বেশি সম্মানিত হননি এখানে। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য বদলের পেছনে তিন শ্রেণির মানুষ বড় অবদান রেখেছে। প্রবাসী শ্রমিকেরা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বিদেশের মাটিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশে অর্থ পাঠিয়েছেন। তাদের পাঠানো রেমিটেন্সে শুধু তাদের পরিবারের নয়, ভাগ্য বদল হয়েছে বাংলাদেশেরও। কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গার্মেন্ট খাত। কয়েক লাখ নারী শ্রমিক আর উদ্যোক্তার ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টায় সাধিত হয়েছে এ অগ্রগতি। আর এদেশের কৃষক নীরবে নিভৃতে বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সাধন করেছেন অসাধ্য।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের উদ্দেশ্য কী ছিল? বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা হলো তা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায়। অষ্টম সংশোধনী মামলায় রায়ে সুপ্রিম কোর্ট যাকে সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করেছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া ২ [জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের] মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি; ৩ [ আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে] আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
সংবিধানের প্রস্তাবনায় এটা স্পষ্ট যে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল না। লাখ লাখ মানুষের ত্যাগ তিতিক্ষার পেছনে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠারও উদ্দেশ্য ছিল। স্বাধীনতার এত বছর পরও বাংলাদেশ এখনও এসব উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেনি। আইনের শাসনের পরিপন্থি নতুন নতুন উপসর্গ যোগ হচ্ছে প্রতিদিনই। গত কয়েকবছরে গুম একটা আতঙ্ক জনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। হঠাৎ হঠাৎ মানুষ নাই হয়ে যাচ্ছেন। কেউ ফিরছেন, কারও লাশ ফিরছে, কেউ আর ফিরছেনই না।
অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে অর্জনের উল্টোচিত্র রাজনীতিতে। এ দেশে গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর একের পর এক অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর দেশ আবার গণতান্ত্রিক ধারা ফিরেছিল। কিন্তু এত বছরে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো মডেল বাংলাদেশ গ্রহণ করতে পারেননি। জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে এগিয়েছে ভোটের রাজনীতি। নিরপেক্ষ আম্পায়ার খোঁজা হয়েছে। কয়েকটি নির্বাচন মোটামুটি অংশগ্রহণমূলকও হয়েছে। দলীয়করণের কারণে সে ব্যবস্থাও বিতর্কিত হয়েছে। পরে অবশ্য তার মৃত্যুই ঘোষণা করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়েই বিতর্কে লিপ্ত। সমাজ-রাষ্ট্র ভয়ঙ্করভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। দোষিত রাজনীতি সর্বত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর তালুকদার মনিরুজ্জামান সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ইংগিত দিয়েছেন মূলত জাতীয়তাবাদকে ঘিরেই এই বিভক্তি। অনিশ্চিত রাজনীতি শেষ পর্যন্ত কোথায় যায় কে জানে!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন