সব সময় সংবিধান মেনেই কেন চলতে হবে, সে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার দাবি, সংবিধান মেনে চললেই সেটা গণতন্ত্র হয় না।
সংবিধানের বিধান অনুযায়ীই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে- জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন অবস্থানের সমালোচনা করে এ কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব।
ফখরুল বলেন, ‘‘সংবিধান ও গণতন্ত্র সবসময় সমার্থক বা সমান্তরাল হয় না। তাই যদি হতো তা হলে হিটলার ও মুসোলিনির শাসনকেও গণতান্ত্রিক বলা যেত। কারণ তাদের শাসনও সংবিধান অনুযায়ীই ছিল।’
উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ এবং বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদে ফিরিয়ে এনে করা ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শাসনকে পাকাপোক্ত করার ব্যবস্থাই করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন বিএনপি নেতা।
শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তার ভাষণে হতাশার কথা বলেছিলেন ফখরুল। পরদিন দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতেই এই সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে জানান, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। সব দল এতে অংশ নেবে বলে আশার কথা বললেও গত নির্বাচনের মতোই কেউ কেউ ‘অরাজক পরিস্থিতি’ তৈরি করতে পারে বলে দেশবাসীকে সতর্কও করেছেন শেখ হাসিনা।
বিএনপির নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি পরোক্ষভাবে নাকচ করে প্রধানমন্ত্রী জানান, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার সর্বতোভাবে নির্বাচন কমিশনারকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে যাবে।
এর জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘তার (প্রধানমন্ত্রী) ভাষণ জাতিকে হতাশ, বিস্ময়-বিমূঢ় এবং উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এই ভাষণে বিদ্যমান জাতীয় সঙ্কট নিরসনে স্পষ্ট কোন রূপরেখা নেই।’
‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা খুবই অস্পষ্ট, ধোঁয়াশাপূর্ণ, এবং বিভ্রান্তিকর।’
সংলাপে বসার দাবি
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যা বলেছেন, সে বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট কোন বিধান নেই বলেও মন্তব্য করেন ফফরুল।
‘সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার কেবল রুটিন ওয়ার্ক করবে- এমন কিছু উল্লেখ নেই।’
তারপরও এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোনো বিশেষ ভাবনা থাকলে তা নিয়ে বিএনপি সংলাপে আগ্রহী বলে জানান দলের মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যদি আন্তরিকভাবে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে নতুন কিছু ভেবে থাকেন তা হলে তাঁর উচিত হবে এ নিয়ে সকল স্টেক-হোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া।’
ফখরুল বলেন, তার দল মনে করে একটি আন্তরিক ও হৃদ্যতপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে ২০১৮ সালের নির্বাচন সম্পর্কে অর্থবহ সমাধানে আসা সম্ভব।
নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কেমন হতে পারে, তা নিয়ে বিএনপির একটি চিন্তা-ভাবনা আছে জানিয়ে ফখরুল বলেন, ‘একটি সুন্দর পরিবেশে সংলাপটি অনুষ্ঠিত হলে জাতির মনে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে আমরা আস্থা রাখতে চাই।’
আইয়ুব শাসনামলের সঙ্গে আ.লীগের তুলনা
পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন সেনা প্রধান আইয়ুব খান। তিনি ক্ষমতায় থাকতে যে কৌশল নিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগও একই কাজ করছে বলেও দাবি করেন ফখরুল।
ফখরুল বলেন, ‘পাকিস্তানি আমলের স্বৈরশাসক ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য যে ধরনের চমকের আশ্রয় নিয়েছিলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও সেই একই পথে হাঁটছে।’
প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের দাবি প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তার শাসনের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণভাবে উন্নয়ন দশক পালন করেছিলেন। গণতন্ত্রহীন তথাকথিত উন্নয়ন জনগণ গ্রহণ করেনি। পরিণতিতে তার মত লৌহমানবকে ক্ষমতা থেকে গণঅভ্যুত্থানের মুখে বিদায় নিতে হয়েছিল।’
‘বর্তমান সরকারও উন্নয়নমেলা করছে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস’- এই মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, ‘এ দেশের সচেতন জনগণ সবকিছু জানে ও বোঝে। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের কোন মন্তব্য বাহুল্যই হবে মাত্র।’
প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন ‘পরিসংখ্যানের তেলেসমাতি’
প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন সেটি অতিরঞ্জিত বলেও দাবি করেন ফখরুল। বলেন, ‘পরিসংখ্যানের তেলেসমাতি করে সরকার বরাবরই জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রীও তাই করলেন।’
ফখরুল বলেন, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বার্ষিক হার ৩.১ শতাংশ হলেও ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বার্ষিক হার ১.৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি প্রকৃত মজুরি কমে যাচ্ছে বলেও দাবি করেন বিএনপি নেতা। জনগণের জীবন মান নিম্নমুখী হয়েছে।
মেগা প্রকল্পকে ‘উন্নয়নের শোকেস’ হিসেবেও আখ্যা দেন ফখরুল। দাবি করেন এসব প্রকল্পের ব্যয় ভারত, চীন ও ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনি, বেসিক ব্যাংকসহ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে জনগণের অর্থ লোপাট হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন বিএনপি নেতা।
সরকার দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনার কথা বললেও সেটা প্রতিশ্রুতির চেয়ে কম হারে কমছে বলেও মন্তব্য করেন ফখরুল। বলেণ, ‘সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল ২০২১ সালের মধ্যে শতকরা ১৩ ভাগে নিয়ে আসা। সরকারের চলতি মেয়াদে দারিদ্র্যের আনুমানিক হার ১৫ শতাংশের নীচে নামানোর কথা ছিল। বাকি ১ বছরে সেটির বাস্তব রূপ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীন। দারিদ্র্য হ্রাসের হার এ সরকারের সময় বরং কমে এসেছে।’
বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দেশের অর্থনীতির প্রতি আস্থার অভাবে দেশ থেকে লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বলেও দাবি করেন বিএনপি নেতা।
ঢাকাটাইমস/
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন