বর্তমান সরকারের শেষ বছরের প্রথমেই নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনৈতিক অঙ্গন। জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ঘিরে সরকারি দল ও বিএনপির বাদানুবাদে স্পষ্ট দুই দল যার যার অবস্থানেই অনড়। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিএনপি ফের সংলাপের আহ্বান জানালেও সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা গতকালও তা নাকচ করে দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৬ সালে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। যার ফলে কী হয়েছে দেশের মানুষ দেখেছে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্ত অর্থাৎ ২০১৮ সালে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিপরীত মেরুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। উভয় দলের উদ্দেশে পরামর্শ থাকবে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। এর বিকল্প নেই।
সংবিধান অনুযায়ী চলতি বছরের শেষ দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিপরীত মেরুতে অবস্থান সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। আওয়ামী লীগ বলে আসছে, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ বহাল রেখে প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন হবে। বিএনপি বলছে, বর্তমান সংসদ ভেঙে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে।
এ অবস্থায় বিএনপি বারবার আলোচনার আহ্বান জানালেও সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছে, আলোচনার সুযোগ নেই।
রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করছেন, সংকট দিনদিন ঘনীভূত হচ্ছে। সমঝোতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দুই দলের মধ্যে দূরত্ব বাড়াচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০০৭ এবং ২০১৪ সালের মতো রক্তাক্ত অবস্থার দিকে যেতে পারে দেশ।
বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্দলীয় সরকারের দাবিতে তারা আন্দোলনে যাবেন। সে জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আন্দোলনের জন্য দলকে প্রস্তুত করতে কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠ পর্যায়ে যাচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আন্দোলনের নামে কোনো অরাজকতা করলে তা বরদাশত করা হবে না। কঠোর হাতে দমন করা হবে। দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে রাজপথে মোকাবিলা করার প্রস্তুতিও নিচ্ছে। তাদের নেতারাও মাঠ পর্যায়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা শুক্রবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষদিকে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার সর্বোতভাবে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে যাবে।’
বিএনপি নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণে দেশের চলমান যে রাজনৈতিক সংকট তা আরও ঘনীভূত হলো। একাদশ সংসদ নির্বাচনের এই বছরে দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে একটা দিকনির্দেশনা থাকবে। কিন্তু তা না থাকায় দেশের মানুষ হতাশ হয়েছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ গতকাল এফডিসিতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংবিধান অনুসারেই নির্বাচন হবে। সুতরাং আমরা আশা করি সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আমরা একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেশে অনুষ্ঠিত হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৬ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ অন্য মন্ত্রীদের বক্তব্যও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মতো ছিল। সে সময় প্রধান দুই দলের কঠোর মনোভাবের কারণে ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের মতো সেনাসমর্থিত সরকার আসতে বাধ্য হয়েছিল। একই কারণে ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়। সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি এড়াতে হলে সংলাপের বিকল্প নেই। তবে সেই সংলাপে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ, সরকার না চাইলে সংলাপ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সব পক্ষকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমাদের সময়কে বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে সরকারকে আলোচনায় বসতে হবে। এখানে কোনো পক্ষকেই একঘেয়ে হয়ে থাকাটা ঠিক হবে না। দুপক্ষকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো বিধান নেই। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী যদি সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তা হলে সেই নির্বাচন কখনো সুষ্ঠু হবে না। কারণ সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকারও হবে বিদ্যমান সরকারেরই অনুরূপ।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, কোনো সহায়ক সরকার নয়, এ সরকারই আগামী নির্বাচনকালীন তিন মাস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারও বিতর্কিত হয়েছে উল্লেখ করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা ও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। বিএনপিও ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই সরকার বৈধ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পাঠক মন্তব্য
হাসিনা আবারো প্রতারণা করে ভোটার বিহীন নির্বাচনের চিন্তা করছে।সে চায় তার বিরোধীদের দমন করে ভোটারের ভোটাধিকার হরণ করে আবারো ক্ষমতা দখল করতে।তার দাম্ভিকতাপূর্ণ কথায় শুধু মিথ্যা আর মিথ্যা যা নাকি ভোটারদের চরম ভাবে আঘাত করার মতো।
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন