বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন-মার্চ ফর ডেমোক্রেসি। কর্মসূচি ঘোষণা দিলেও কর্মসূচিতে অংশ নিতে গুলশানের বাসভবন থেকে বের হতে পারেননি তিনি । পরে বাসায় অবরুদ্ধ থেকেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের ঘোষণা দেন তিনি। ৫ জানুয়ারির আগের রাতেই খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবনের সামনে পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। খালেদা জিয়া বাসা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ বেষ্টনীর সামনে নিজ বাসভবনের ফটকে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রতিবাদে পরের বছর ২০১৫ সালের ৩ জানুয়ারি রাতে আন্দোলনে নেমে গুলশানে নিজ কার্যালয়ে আটকা পড়েন বিএনপি চেয়ারপারসন। কার্যালয় ‘অবরুদ্ধ’থাকা অবস্থায় অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দেন তিনি। প্রথম তিন মাস অবরোধ কিছুটা চললেও পরে তা মিইয়ে যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও সেই অবরোধ তুলে নেয়া হয়নি। ৯২ দিন পর ৪ এপ্রিল কার্যালয় থেকে বের হন এবং পরে আদালত হয়ে বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া।
শুধু এই ঘটনাই নয়, গত চার বছরে বিএনপি অনেক কর্মসূচিই নিয়েছে, কিন্তু প্রতিটি কর্মসূচির শুরু থাকলেও ইতি টানতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে দলটি। বিএনপি যতটা গর্জেছে, ততটা বর্ষেনি, বা বর্ষাতে পারেনি। অনেকে বলছেন, ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যতটা দৌড়ানোর চেষ্টা করেছে, ততটা আগাতে পারেনি।
তবে দলটির দাবি, বসে নেই তারা। দলীয় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি গত চার বছরে বিভিন্ন সিটি নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রতিটি স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। তাই একাদশ জাতীয় সরকার নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু করতে নিরপেক্ষ সরকারের বিকল্প নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রিয়.কমকে বলেন, ‘রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত নেয়া খুবই কঠিন। কখন পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তা আগে থেকে বলা মুশকিল। তবে গণতন্ত্রহীন দেশে যতটা না ব্যর্থতা বিরোধী দলের থাকে, তার চেয়ে বড় ব্যর্থতা তাদের, যারা অধিকার কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় থেকে গণতন্ত্রের মোড়কে গণতন্ত্রকেই হত্যা করে।’
গুলশানের নিজ বাসভবন ফিরোজা’র সামনে গণমাধ্যমে কথা বলছেন বিএনপি নেত্রী। ফাইল ছবি
বিএনপির গত চার বছরের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ জন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজপথে খুব একটা দেখা যায়নি দলটিকে। এমনকি বাম রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকা হরতালে সমর্থন দিয়েও মাঠে নামেনি দলটি।
‘ঈদের পর আন্দোলন’
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে চার বছর বিএনপি অনেকবার আন্দোলনের কথা বলেছে। প্রতি বছরই দলটির শীর্ষ নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন, ‘ঈদের পর কঠোর আন্দোলন’। কিন্তু এর পর আর সেই কর্মসূচির দেখা মেলেনি।
২০১৪ সালের ২২ জুন রোববার বিকেলে জয়পুরহাট জেলার রামদেও বাজলা (আরবি) সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, সরকার নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় না বসলে ঈদের পর আন্দোলন শুরু হবে। আর এতে বাধা দিলে হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগের মতো কর্মসূচি দেয়া হবে।
২০১৫ সালের মধ্য জুলাইয়েও আলোচনা ওঠে অক্টোবরে ঈদের পরে বিএনপি কঠোর আন্দোলনে নামবে। ওই সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, দল পুনর্গঠন করে ঈদের পরেই সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করা হবে। এ লক্ষ্য চেয়ারপারসনের নির্দেশ অনুযায়ী দলের মধ্যে কাজ চলছে। এবারের আন্দোলন জনভিত্তিক ইস্যু নিয়ে শুরু হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, রমজান মাসেও দলের সাংগঠনিক বিষয়ে কাজ চলেছে। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে গতি বাড়াতে এক নেতার এক পদ রাখারও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ঈদের পরে বিএনপি একটি পুরো শক্তির দল হিসেবে রূপান্তরিত হবে।
২০১৬ সালের প্রথম দিকেও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ঈদের পর আন্দোলন। ওই সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে ও সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে বিএনপি আন্দোলনের মধ্যেই আছে। বিএনপি সবসময়ই জনদুর্ভোগসহ জাতীয় ইস্যুতে গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করেছে। ঈদ পরবর্তীতে আন্দোলন জোরদার করা হবে।
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর ২০১৬ সালের ৩ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে দলমত নির্বিশেষে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১০ জুন শনিবার রাজধানীর পূর্বাণী হোটেলে ২০ দলীয় জোটের শরীক দল ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) আয়োজিত ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া বলেন, ঈদের পর সবাইকে নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। দেশে যেভাবে জুলুম, অত্যাচার নির্যাতন হচ্ছে। রোজার পর মানুষ নিজেরাই এই জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলবে।
২০১৫
এ বছরের ৩ জানুয়ারি রাতে গুলশানে নিজ কার্যালয়ে আটকা পড়েন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আটকা থাকা অবস্থায়ই অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দেন তিনি। পরে ৪ এপ্রিল ৯৩ দিন পর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তালা খুলে দেয়া হয়। ৫ এপ্রিল আদালত হয়ে বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া।
নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ নেতাকর্মীরা। ফাইল ছবি
তিন সিটি নির্বাচন : ২০১৫ সালে ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। দুপুরের পর তিনটিতেই বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। জালিয়াতির মহোৎসব হয়েছে বলে অভিযোগ করে। এরপর এ নিয়ে আর কোনো তৎপরতায় দেখা যায়নি।
মোদির ঢাকা সফর : ২০১৫ সালে ৬ জুন দুই দিনের জন্য প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ৭ জুন খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করেন তিনি। এ সময় বিএনপিতে একটা চাঙ্গাভাব দেখা গেলেও কয়েকদিনের মধ্যেই তা মিইয়ে যায়।
শমসের মবিনের সরে যাওয়া : ২০১৫ সালে ২৯ অক্টোবর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী হঠাৎ করেই সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। এ নিয়ে শুরুতে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেও পরে চুপচাপ হয়ে যায় বিএনপি। এ ঘটনাটি বিএনপির রাজনীতিতে একটা বড় ধাক্কা বলে অনেকে মনে করেন।
নিখোঁজ সালাহউদ্দিন ৬২ দিন পর শিলংয়ে : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ ৬২ দিন নিখোঁজ থাকার পর ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে উদ্ধার হন। তাকে মেঘালয় ইন্সটিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্স (মিমহান্স) হসপিটালের সামনে পাওয়া যায়। বর্তমানে তিনি আদালত থেকে শর্তসাপেক্ষে জামিন নিয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন।
১০ মার্চ সালাহউদ্দিনকে উত্তরার একটি বাসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। এ নিয়েও বিএনপির তেমন কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি।
২০১৬
৫ জানুয়ারি কোনোরকমে ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস পালনের মাধ্যমে বছরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে বিএনপি।
দুই দফায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপি কয়েক দফা সম্মেলন করার প্রস্তুতি নেওয়ার পরও তা করতে পারছিল না। যদিও পরে ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ কাউন্সিল আয়োজন করে দলটি। কাউন্সিলের সাড়ে চার মাস পর পূর্ণাঙ্গ কমিটিও ঘোষণা করা হয়। দুটি পদফাঁকা রেখে ১৭ সদস্যের স্থায়ী কমিটি, ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ এবং ৫০২ সদস্যের নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়।
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে বিএনপি। কিন্তু এই ইস্যুতে কোনো কর্মসূচি দেয়নি দলটি।
ইউপি নির্বাচনে বিএনপি : দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের মতো সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচেন বিএনপি অংশ নেয়। যদিও কয়েক ধাপে হওয়া ওই নির্বাচনে বিএনপি ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবি করে। দাবি তুলেই সেই আন্দোলন শেষ।
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে অবস্থান : রামপালে বিতর্কিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার কর্মসূচি গ্রহণের পর নিজেদের অবস্থান জানায় বিএনপি। এই প্রকল্পের সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিকগুলোকে সামনে এনে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকা থেকে প্রকল্পটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবি তোলে দলটি। তবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে বিএনপির তরফ থেকে কোনো ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচির কথা ঘোষণা করা হয়নি।
জিয়ার সমাধি সরানোর খবরে সোচ্চার : সংসদ ভবন ও এর আশপাশের এলাকায় লুই আই কানের মূল নকশা বহির্ভূত সব স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার সরকারি ঘোষণার পর সোচ্চার হয়ে ওঠে বিএনপি। দলটির নেতারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘সেখানে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে। এখন সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়ার সমাধি সরানো হলে ভবিষ্যতে জনগণ ক্ষমতাসীনদের আত্মীয়স্বজনদের সমাধির দিকেও হাত বাড়াতে পারে।’
জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার: বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারের জন্য জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সিদ্ধান্তে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে বিএনপি। জিয়ার মরনোত্তর স্বাধীণতা পদক প্রত্যাহারকে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপ্রসূত’ আখ্যা দিয়ে দলটি বলে, ‘এই সিদ্ধান্ত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরো সংকটময় ও জটিল করে তুলবে।’এটিও বক্তৃতা বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল ।
নিজের টুইটার একাউন্টে টুইট। ফাইল ছবি
টুইটারে খালেদা: সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম টুইটারে এ বছর নিজের অ্যাকাউন্ট খোলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর দলের ৩৮ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনাসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে তার এই অ্যাকাউন্ট উদ্বোধন করেন বিএনপি নেত্রী নিজেই। এই অ্যাকাউন্ট থেকেই তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ইস্যুতে টুইট করে যাচ্ছেন।
হলি আর্টিজানে হামলা ও বিএনপির জাতীয় ঐক্য : ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবার প্রতি আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। এ জন্য দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক জোটের বাইরে থাকা বামদলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে না করতেই এতে হোঁচট খায় বিএনপি। একমাত্র কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী ছাড়া আর কারো সঙ্গে আলোচনা এগিয়ে নিতে পারেনি দলটি।
সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বিএনপি নেতা গ্রেপ্তার : সরকার উৎখাতে ইসরায়েলের সঙ্গে ‘ষড়যন্ত্রে’ জড়িত বলে অভিযোগ ওঠার পর ১৫ মে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রস্তাব : নতুন ইসি গঠনে ২০১৬ সালের ১৮ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে একগুচ্ছ প্রস্তাব রাখেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এই প্রস্তাব নিয়ে আর কোনো কর্মকাণ্ডে দেখা যায়নি দলটিকে।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা : নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার শুরু দিন ১৮ ডিসেম্বর বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। সংলাপে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে বাছাই কমিটি গঠনের বিষয়ে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির কাছে ‘সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব’ দেন।
নাসিক নির্বাচন : প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে হওয়া নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে যায় দলটি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী জয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে নারায়াণগঞ্জের মেয়র নির্বাচিত হন। তবে এই পরাজয়ের বিষয়টিকে নির্বাচনে কারচুপি হিসেবে দেখছে বিএনপি। দলটির দাবি, খালি চোখে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে মনে করা হলেও অভ্যন্তরীণ কারচুপি হয়েছে। এ নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তও দাবি করেছেন বিএনপি নেতারা। ওই পর্যন্তই শেষ।
২০১৭
বছরের শুরুতে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলই মুখোমুখি পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়ায়। ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ‘গণতন্ত্র হত্যা্ দিবস’ উপলক্ষে ‘কালো পতাকা মিছিলের’ কর্মসূচি দেয় বিএনপি। এ উপলক্ষে সমাবেশ করতে চেয়ে অনুমতি না পেয়ে সারা দেশে বিক্ষোভের ডাক দেয় দলটি।
নতুন ইসিতে বিএনপির আপত্তি: রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যেমে ফেব্রুয়ারিতে নতুন নির্বাচন কমিশন ঘোষণা হলে তাতে আপত্তি জানিয়ে নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদার পদত্যাগ চায় বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো। এর পর আর তা নিয়ে কোনো কের্মসূচি দেখা যায়নি।
খালেদা জিয়ার ভিশন- ২০৩০: বছরের মাঝামাঝিতে এসে ১০ মে বিএনপির ভিশন-২০৩০ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন খালেদা জিয়া। তার ৪১ পাতার বইয়ের এই ভিশন রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত হয়। এ নিয়েও আর কোনো কর্মসূচি দেয়নি বিএনপি।
‘তছনছ’ খালেদার কার্যালয়: খালেদা জিয়া বিএনপির ভিশন-২০৩০ তুলে ধরার দশদিন পর ২০১৭ সালের ২০ মে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে তল্লাশি চালায় পুলিশ। অফিসটি ‘তছনছ করা’ হয়েছে অভিযোগ করে তখন বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘অভিযানে পুলিশের প্রাপ্তি শূন্য’।
উখিয়ায় খালেদা: ২৮ অক্টোবর কক্সবাজারের উখিয়ার উদ্দেশে ঢাকা থেকে রওনা দেন খালেদা জিয়া। মাঝে চট্টগ্রামে যাত্রাবিরতি দিয়ে ৩০ অক্টোবর উখিয়া যান বিএনপি নেত্রী। উখিয়া যাওয়ার দিন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা হয়। উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিয়ে ফেরার পথেও গাড়িবহরে হামলা হয়।
বছরের শেষে মাঠে বিএনপি: ১২ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করে বিএনপি। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি ডিঙিয়ে ঢাকায় বিএনপির জনসভায় নেতাকর্মীদের ‘ব্যাপক স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত’ দেখা যায়।
জোটের বৈঠকের একটি চিত্র। ফাইল ছবি
উভয় সংকটে বিএনপি: বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিকদের নিয়ে প্রায়ই উভয় সংকটে পড়ে দলটি। জোটের বেশ কয়েকটি দলের মধ্যে বিভাজন তৈরি হওয়ার পর ভেঙে দুই খণ্ড হয়ে যাওয়ার ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। ২০১৭ সালে জোটের দুই দল লেবার পার্টি ও জমিয়তে উলামা ভেঙে দুই খণ্ড হয়ে যায়। এর আগে যে শরিক দলগুলো ভেঙেছে তার একটি অংশ জোট থেকে বেরিয়ে গেলেও অন্য অংশকে জোটেই থাকতে দেখা গেছে। তবে এবার লেবার পার্টি ও জমিয়তে উলামায়ে দল দুটি ভেঙে গেলেও কোনো অংশই জোট থেকে বেরিয়ে যায়নি। বরং দলগুলোর দুটি অংশই জোটে থাকতে চাইছে। এ নিয়ে এক প্রকার উভয় সংকটে রয়েছে বিএনপি। যদিও এই বিষয়ে ধীরে চলো নীতিতে রয়েছে জোটের প্রধান দল বিএনপি।
বিজয় র্যালি: ১৭ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে বিজয় র্যালি করেছে বিএনপি। ব্যাপক জনসমাগম ঘটিয়ে র্যালির আদলে রাজপথে শোডাউন করেছে দলটি।
মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ: ২৪ ডিসেম্বর বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের উদ্যোগে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দেন খালেদা জিয়া।
সর্বশেষ চলতি বছরের ২ জানুয়ারি অনুমতি ছাড়াই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আলোচনাসভায় গিয়ে উপস্থিত হন খালেদা জিয়া।
নেতাদের দাবি
এসব বিষয়ে কথা হলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রিয়.কমকে বলেন, অধিকার প্রতিষ্ঠায় দাবি আদায়ে হত্যা গুম খুনের চলমান পরিস্থিতিতেও রাজনৈতিক দল হিসেবে বিগত চার বছরে বিএনপির কিছু ব্যর্থতা থাকলেও সাফল্যের পথচলা দীর্ঘ।
রিজভী বলেন, ‘জনমত গঠনে বিএনপির প্রথম সফলতা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে কোনো নির্বাচন হয়নি তা প্রমাণ করতে পারা। এতো দমন নিপীড়নের মাঝেও ২০১৬ সালে মার্চ মাসে আমরা দলের সফল ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে পেরেছি। ইতিমধ্যে সাংগঠনিক ৭৭ টি জেলার মধ্যে ৫১টি সাংগঠনিক জেলা কমিটি সম্পন্ন করেছি। দলের সদস্য নবায়ন ও সদস্য সংগ্রহ এখনও অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়াও দলের বিভিন্ন অঙ্গ সহযোগী সংগঠন যেমন ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, শ্রমিকদল, মুক্তিযোদ্ধা দলের আংশিক হলেও নতুন কমিটি করেছি। বিশেষ করে দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর পর বিএনপির ঢাকা মহানগর কমিটি ঘোষণা করতে পেরেছি। শুধু তাই নয়, ঢাকা মহানগরকে উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই ইউনিটে প্রতিটি পর্যায়ে কমিটি গঠন করেছি।’
অবরোধ চলাকালীন একটি ছবি। ফাইল ছবি
সাবেক এই ছাত্রনেতা দাবি করেন, ‘মোট কথা দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির কোনো ব্যর্থতা নেই। কারণ আমরাই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি থেকে শুরু করে প্রতিটি জনসম্পৃক্ত আন্দোলন কর্মসূচি পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছি। সর্বশেষ গেল বছরের শেষ দিকে মিয়ানমার থেকে (কক্সবাজারের রোহিঙ্গা) ক্যাম্পে প্রথম থেকে ফ্রি মেডিক্যাম্প চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকায় একটি সর্বকালের সেরা জনসভাও করেছি।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু প্রিয়.কমকে বলেন, ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় চার বছর অতিবাহিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় মহাজোট। তারা দেশে উন্নয়নের নামে মেগা হরিলুট আর রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে অন্যায় ও বেআইনিভাবে ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে অনুমতির ভেড়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছে। তাই এর থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্ত করার চ্যালেঞ্জ নিয়েই বিএনপি সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়.কমকে বলেন, কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ না নিলেও সবাই এখন ম্যাডাম খালেদা জিয়ার নজরে আসতে কোর্টে হাজিরার দিন জড়ো হয়। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই বিগত চার বছরে সঠিক সিদ্ধান্ত, সমন্বয়হীনতা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-গ্রুপিং এমনকি বিশেষ সময়ে (দাবি আদায়ে আন্দোলন) নিজ স্বার্থে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় সম্পৃক্ত হওয়ার পর আমাদের (বিএনপি) বর্তমান অবস্থান অনেকটাই নড়বড়ে। যার কারণে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে দলের সাংগঠনিক দিকে বেশি নজর দিতে হচ্ছে।
আর বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অনেকের অভিযোগ, বিএনপির দলীয় কার্যক্রম এখন কেন্দ্রভিত্তিক। অনেকে ক্ষমতাসীনদের সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে। আর দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার পেছনে অন্যতম একটি হচ্ছে, এই মুহূর্তে বিএনপি অনেকটা হাফটাইম পলিটিক্স করছে। যা দিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরণ কঠিন।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন