নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে দেশে ফেরেন। দ্বিতীয় বিয়ে করেন। নিজের ব্যবসা ও নতুন সংসার নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন। ছেলে-মেয়েকে ঠিকমতো সময় দিতে পারতেন না। এরই মধ্যে বড় ছেলের মাঝে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে থাকে। এক পর্যায়ে ‘জঙ্গিবাদে’ জড়িয়ে ঘর ছাড়ে কিশোর নাফিস উল ইসলাম (১৬)। বাড়ি ছাড়ার সময় ৬০ হাজার টাকা সঙ্গে নেয়। এমন তথ্য জানিয়ে চট্টগ্রামে জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত পারিবারিক অশান্তি থেকেই ‘জঙ্গিবাদে’ পড়িয়ে পড়ে নাফিস। নাফিসের অশান্তিতে থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাকে জঙ্গি দলে ভেড়ানো হয়।
গত বছরের ৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম কলেজসংলগ্ন বাসা থেকে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয় নাফিস। ছেলের সন্ধান চেয়ে পরদিন চট্টগ্রামের চকবাজার থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন নাফিসের বাবা নজরুল ইসলাম। এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে চট্টগ্রামের গোয়েন্দা পুলিশ নগরীর মাদারবাড়ী এলাকায় জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায়। সেখান থেকে সুইসাইডাল ভেস্টসহ তিন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নাফিস ঘর ছাড়ার পর তার কক্ষে ‘উগ্রবাদে’ যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো ৬টি লিফলেট ও একটি বই পান তার বাবা। সেগুলো পুলিশের কাছে দেন। এর সূত্র ধরে শুরু হয় তদন্ত।
এ ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের কাজেম আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল নাফিস। ন¤্র-ভদ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। স্কুলে নাফিসের ক্লাসের বিভিন্ন স্থানে এফএম লিখে রেখেছিল। তার বন্ধুরা এসব ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে নাফিস জানিয়েছিল, এফএম হলো ফোর্স অব মুজাহিদিন। শান্ত স্বভাবের নাফিসের জঙ্গিবাদে জড়ানোর ঘটনায় অবাক হয়েছেন তার বন্ধু ও স্বজনরা।
সূত্র জানায়, নাফিসের বাবা দীর্ঘ ১৫ বছর ওমানে ছিলেন। সেখান থেকে ফিরে ২০১০ সালে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। নাফিসের ৯ বছর বয়সী একটি ছোট বোন রয়েছে। নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে রয়েছে ৩ বছর বয়সী আরেক কন্যাসন্তান।
নাফিসের বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানিয়েছে, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে নাফিসের আচরণে পরিবর্তন দেখা দেয়। সে তখন থেকে কথাবার্তা কম বলতে শুরু করে।
সূত্র জানায়, জঙ্গি মেজবার প্ররোচনায় জঙ্গিবাদে জড়ায় নাফিস। চট্টগ্রামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে চট্টগ্রামের একটি বাসায় ওঠে নাফিস। পরে মেজবার মাধ্যমে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর একটি মেসে ওঠে। সেখানেই আত্মঘাতী হওয়ার প্রশিক্ষণ পায়। নাফিসের সাংগঠনিক নাম আবদুল্লাহ। এই নামে তার একটি ফেসবুক আইডিও ছিল।
নাফিসের বাবা নজরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আমরা তেমন কোনো পরিবর্তন তার মধ্যে দেখতে পাইনি। তবে তার রুম থেকে ফরম ও বই পেয়ে তা পুলিশকে দিয়েছিলাম।
গত ১২ জানুয়ারি গভীর রাতে রাজধানীর নাখালপাড়ার রুবি ভিলায় র্যাবের অভিযানে তিন ‘জঙ্গি’ নিহত হয়। ‘জঙ্গি আস্তানা’টি ছিল পুরান ন্যাম ভবনের পেছনের দিকে। আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ওই আস্তানার দূরত্ব প্রায় দেড়শ গজের মতো। ষষ্ঠ তলা বাড়িটির পঞ্চম তলার মেসের একটি কক্ষে চলতি মাসে ভাড়া নিয়েছিল নিহত জঙ্গিরা।
নিহত তিনজনের মধ্যে মেজবা উদ্দিন (২৫) নামে এক জঙ্গির পরিচয় প্রথমে প্রকাশ করে র্যাব। এরপর অপর দুই জঙ্গির ছবি প্রকাশ করে সংস্থাটি। এরপরই মূলত বেরিয়ে পড়ে নাফিসের পরিচয়। পরে র্যাবের একটি দল নাফিসের বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সূত্র জানায়, গত ১৮ নভেম্বর তার ফেসবুক আইডি থেকে সৌদি প্রবাসী চাচাত ভাই পারভেজকে মেসেজ দেয় নাফিস। পারভেজ তার অবস্থান জিজ্ঞেস করলে ফেসবুক আইডিটি ডি-অ্যাকটিভেট করে দেয়। ওই সময়ে ওই আইডির অবস্থান ছিল যাত্রাবাড়ী এলাকায় বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। নাখালপাড়ার জঙ্গিবিরোধী অভিযানের তদন্ত করছে র্যাব-৩। র্যাব ৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরানুল হাসান আমাদের সময়কে বলেন, নাফিসের বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্যের সূত্র ধরে তদন্ত চলছে।
অবশ্য অভিযানের পর র্যাব জানিয়েছিল তিন জঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করে। অপর এক জঙ্গির পরিচয় গতকাল পর্যন্ত জানাতে পারেনি র্যাব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন